গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙাল হরিনাথ মজুমদার

শরীফুল ইসলাম/

আজ ৫ শ্রাবণ। গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ১৮৭তম জন্মবার্ষিকী। অগ্রণী সাংবাদিক হিসেবে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ১২৪০ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে এইদিনে কুষ্টিয়ার কুমারখালির কুন্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কুমারখালি থেকে প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। পত্রিকাটি ১৮৬৩ সাল (১২৭০ বৈশাখ) থেকে প্রায় ২২ বছর প্রকাশিত হয়। ১৮৭৬ সালে কুমারখালিতে অক্ষয় কুমার মৈত্রের বাবা মথুরানাথ মৈত্রের নামে কাঙাল হরিনাথের নিজ কুটিরে একটি মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করা হয়, যার নাম দেয়া হয় এমএন প্রেস। ছাপাখানাটি আজও আছে কুমারখালির কুন্ডুপাড়ায় কাঙাল কুটিরে। যে কুটিরে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ বহুবার এসে হরিনাথের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছেন।

তার সম্পাদনায় গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশিত হতো কুমারখালি থেকে। ‘গ্রামবার্তা’ শুরুতে মাসিক হলেও পরে পাক্ষিক , সাপ্তাহিক এবং পুনরায় মাসিক হিসাবে প্রকাশিত হয়। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র কারণে সে সময় সৃষ্টি হয়েছে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেনের মতো লেখক।
৪০টি গ্রন্থও রচনা করেন কাঙাল হরিনাথ। অবশ্য সব প্রকাশিত হয়নি। তার সাহিত্যপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় ‘কবিতা কৌমুদী’ এবং ‘বিজয় বসন্ত’ (১৮৬৯) শীর্ষক উপন্যাসে। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কুমারখালির হরিনাথ মজুমদার প্রণীত ‘বিজয় বসন্ত’ ও টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

শৈশবে বাবা-মা হারিয়ে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে কাঙাল হরিনাথ লেখাপড়া শিখেছিলেন সামান্যই। বালক বয়সে তিনি কুমারখালি বাজারে কাপড়ের দোকানে কাজ নিতে বাধ্য হন। এরপর ইংরেজদের কুঠির হেড অফিস কুমারখালি নীল কুঠিতে (৫১টি নীল কুঠির প্রধান) শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন।

গবেষকদের মতে, শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতনের প্রতিকারের চিন্তা থেকেই পরবর্তী সময়ে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করেন।

এ পত্রিকাতেই ফকির লালন সাঁইজির গান প্রথম ছাপা হয়। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ সে যুগে জমিদার, মহাজন, পুলিশ, ব্রিটিশ সরকার এমনকি জোড়াসাঁকোর বাবু জমিদারদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিল। এজন্য তার উপর প্রায়ই কোর্ট থেকে মানহানির সমন ও সতর্কতাপত্র আসতো এবং সরকারি নির্দেশে মাঝে মাঝে পত্রিকা বন্ধ রাখতে হতো।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হরিনাথকে শায়েস্তা করতে লাঠিয়াল বাহিনী পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। এই খবর পেয়ে লালন শাহ’র শিষ্যরা একতারা ফেলে সরকি-বল্লম নিয়ে লাঠিয়ালদের কলকাতা হটিয়ে দিয়েছিলেন।

কাঙাল হরিনাথ ১৮৫৪ সালের ১৩ জানুয়ারি কুমারখালিতে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন এবং সেখানে অবৈতনিক শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তার উদ্যোগে ১৮৬৩ সালে কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বর্তমানে সেটি ‘কুমারখালি সরকারি পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ হিসেবে পরিচিত।

১৮৭৬ সালে কুমারখালিতে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র বাবা মথুরানাথ মৈত্রেয়র নামে কাঙাল হরিনাথের নিজ কুুটিরে একটি মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করা হয়, যার নাম দেয়া হয় এমএন প্রেস। ছাপাখানাটি আজও আছে কুমারখালির কুন্ডুপাড়ায় কাঙাল কুটিরে।

১৬ই এপ্রিল, ১৮৯৬ সালে এই ক্ষণজন্মা লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, “নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো”। (শ্রমিক আওয়াজ এর সৌজন্যে)