আমার সাংবাদিকতা শুরুর দুরন্ত অভিযাত্রা

আবুল কালাম আজাদ /

১৯৮০ সালের মার্চ মাস।গুরুদাসপুর বিলচলন শহীদ ডঃ শামসুজ্জোহা কলেজে   উচ্চ মাধ্যমিক  দ্বিতীয়  বর্ষের ছাত্র আমি। আমার বাড়ি শিকারপুর থেকে প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার পশ্চিমে থানা সদরে কলেজ।  বয়ে যাওয়া গুমানী নদীর দক্ষিন পাড় জঙ্গলের মধ্যে পায়ে হাটা ভাঙ্গা রাস্তা  দিয়ে পায়ে হাটা মেঠো পথে প্রতিদিন পায়ে হেটে অথবা সাইকেলে কলেজে যাতায়াত করতাম। সে সময় এখনকার মত পাকা বা প্রশস্ত কোন রাস্তা ছিলনা। একমাত্র পা অথবা সাইকেলই ভরসা।

সকাল ৮ টার দিকে খেয়ে সাইকেল নিয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি । এই সময়  চাঁচকৈড় থেকে তরুন  সাংবাদিক কিরন আর আবুল ( দুইজনই আমার জুনিয়ার, বয়সেও ছোট, তারা চাঁচকৈড় নাজিম উদ্দিন হাইস্কুলের ছাত্র ) আমার বাড়িতে দুইজন সাইকেল নিয়ে এসে হাজির।    আমি জানতে চাইলাম , তোমরা কোথায় যাচ্ছো? কিরন জানালো ,তাড়াশ থানার সিও (রাজস্ব) অফিসে জমি বিষয়ে কাজ আছে তাই আমরা তাড়াশ যাচ্ছি।আমাকেও  যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিল। আমি কলেজে যাওয়ার জন্যে প্রস্ততই ছিলাম । প্রস্তাব পাওয়ার সাথে সাথে বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই সাইকেল নিয়ে তিনজন রওনা দিলাম। শিকারপুর বাড়ি থেকে বাহাদুরপাড়া  গুমানি নদির ভাঙ্গা পাড়ের পা হাঁটা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ধামাইচ বাজার ত্রি মোহনা ঘাটে খেয়া পাড় হয়ে কুশাবাড়ি- চরকুশাবাড়ি গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলনবিলে  বিশাল খোলা মাঠে ঢুকি। চলনবিলের রাস্তা এত খারাপ যে , সাইকেল চালিয়ে  যাওয়ার কোন উপায়ই ছিলনা। কিরন সাইকেল চালানোতে দুর্বল। গরু-মহিষের  কাদার পাওটা  এবং গাড়ি নিড়িকের মধ্যে দিয়ে যাওয়ায়  (পাওটা গাড়ির চাকায় কাদা উঠে চিকন চিকন লাইন)  শুকায়ে ধারালো হয়ে শক্ত হওয়ায় হেঁটে যাওয়া খুবই কষ্টদায়ক। এদিকে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে আমরা ঘেমে অস্থির। এভাবেই কখনো সাইকেল ঠেলে হেঁটে , কখনও  সাইকেলে চড়ে দীর্ঘ ১০/১২ কিলো  দুর্গম মেঠ পথ গনগনে আগুনে রোদ মাথায় নিয়ে সাড়ে ১২ টার দিকে তাড়াশ গিয়ে পৌছাই।

তাড়াশ পৌছে প্রথমে সিও অর্থাৎ সার্কেল অফিসার  (রাজস্ব) অফিসে কিরনের জমির কাজ সেরে  চলনবিল প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক (রাজু চাচা )[বর্তমানে তাড়াশ থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তার সম্পাদক’] , সাইদুর রহমান সাজু এবং রুহুল আমিন মাষ্টারকে খোঁজ করি।

১৯৮০ সালে তাড়াশ বাজারে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দোকান ছিল। খোঁজ করে যে ষ্টলে সাংবাদিকরা বসেন সেই ষ্টলে গিয়ে তিনজনকেই এক সাথে পেলাম। কিরন, আবুল বয়সে ছোট হলেও তারা আগে থেকেই সাংবাদিকতা এবং চলনবিল প্রেসক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত। আমি ১৯৭৮ সালে এস এস সি পাশ করে  গুরুদাসপুর বিলচলন ডঃ শহীদ শামসুজ্জোহা ডিগ্রী কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর কলেজ ছুটির হলে  বাড়ি যাওয়ার পথে সুযোগ পেলেই চাঁচকৈড় শিক্ষা সংঘে গিয়ে  প্রেসক্লাবে বসে পেপার পড়তাম। সেই সুবাদে কিরন , আবুলসহ  সাংবাদিকদের সাথে আমার পরিচয় হয়।আমার মেঝ চাচা সাংবাদিক অধ্যাপক শামসুর রহমানও  ছিলেন চলনবিল প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এই সুত্রে রাজু চাচা ,সাজু চাচা, রুহুল আমিন মাষ্টার তাড়াশ থেকে  চাঁচকৈড় প্রেসক্লাবে আসার পথে এবং যাওয়ার পথে আমাদের বাড়িতে উঠতেন । বসতেন আমার  পড়ার ঘরে। পড়ার ফাঁকে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শুনতাম। শামসু চাচা  ইংরেজি পত্রিকায় লিখতেন। সংবাদ ছাপা হলে আমার আব্বাকে দেখাতেন। আমাদের তিনজনকেই হোটেলে  উপস্থিত আরো কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে পরিচয় করে দিলেন রাজু এবং সাজু চাচা।  আমাদের তিন জনকে নাস্তা করালেন।

নাস্তা শেষে দেড়টার দিকে আমরা বাড়িতে আসার জন্যে হোটেল থেকে বেড় হয়ে বাজারে ঢোকার পথে  আবুল প্রস্তাব দিল আমরা সাইকেল চালিয়ে বগুড়া যাব।প্রস্তাবে আমি কিরন দুইজনই রাজি হয়ে গেলাম। কোন পথে যাব ? আমরাতো কেউই পথ চিনিনা। আমি শুনেছি তাড়াশ হয়ে বগুড়া যাওয়া যায়। কিন্তু কোন পথে জানিনা। আবার আমরা হোটেলে আসি  রাজু ও সাজু চাচার কাছে বগুড়া যাওয়ার পথের সন্ধান নিতে। তারা জানালেন, তাড়াশ বাজারের পশ্চিমে বিনসারার পথ ধরে সোজা উত্তরে যেতে হবে।  মির্জাপুর হাটে নগরবাড়ি –বগুড়া মহা সড়কে উঠতে হবে।সে অনেক পথ। চৈত্রের দুপুরের রোদের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে বগুড়া যাত্রার কথা শুনে উপস্থিত সবাই আশ্চর্য্য হলেন। কেউ আবার যাত্রায় নিশেধও করলেন। আমরা সিদ্ধান্তে অটল। আমরা যাবই। রাজু চাচা দুপুরে হোটেলে খাওয়ার জন্য বললেন। আমরা না খেয়েই রওনা হলাম।

হঠাত সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি থেকে তাড়াশ-, তাড়াশ থেকে  বগুড়া সাইকেল চালিয়ে যাওয়া ছিল সত্যি আমাদের তিনজনের জীবনের প্রথম এবং অন্যরকম এডভেন্সার। এদিকে বাড়িতেও না জনিয়ে হঠাত করে ভাবাবেগে বেড় হয়ে এসেছি। তবুও তারুন্যের আবেগে বাপ-মায়ের পিটুনি-বকুনি ভাগ্যে বরণ করেই বগুড়া যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থেকে  রওয়ানা হলাম।

তিনজন বুকে সাহস নিয়ে বিলের কাঁচা রাস্তায় সাইকেলে চড়ে প্যাডেল মারা শুরু করলাম। আমার  সাইকেল ছিল নতুন। কিরনের সাইকেল  আধা পুরাতন আর আবুলের সাইকেল ছিল পুরাতন। তবে, আবুলের সাহস ও শক্তি ছিল অস্বভাবিক। দুপুরের কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে  কখনও পাশাপাশি, কখনও আগপিছ হয়ে সাইকেল চালাচ্ছি। আবুল খুব আমুদে ছিল। সে মাঝে মাঝ গান গেয়ে আনন্দ দিচ্ছিল। ৫/৬ কিলো যাওয়ার পর ক্ষূধা আর পানির পিপাসায় প্যাডেলে আর পা চলছিলনা। তাড়াশ থেকে সম্পুর্ন রাস্তা কাঁচা। ধু ধু ধুলা মাড়িয়ে  চলছি। কোথাও খবার পানিও পাচ্ছিনা। রাস্তার আশেপাশে বাড়িঘরও নাই। এর মধ্যে একটা ছোট বটগাছের ছায়ায় নেমে জিড়িয়ে নিলাম। পাশের বাড়ি থেকে পানি চেয়ে পান  করলাম। অধিক পিপাসায় পানির স্বাদ উপভোগ করলাম কিন্তু ক্ষুধা মিটলনা। আবার পথচলা শুরু করলাম। ২/৩ কিলো পথ  যেতেই দেখা পেলাম জঙ্গল ভিটায় বড় বটগাছের মোড়ে একজন ক্ষিরা  আর পানি নিয়ে বসে আছে। সময় প্রায় বিকাল ৫ টা । কিরণ বললো, ক্ষিরা খাব।  ক্ষুধায় আর চলতে পারছিনা।  পথও শেষ হচ্ছেনা। নেমে ক্ষিরা খাওয়া শুরু করলাম। তিনজনে প্রায় ৪ সের ক্ষিরা খেয়ে বটগাছের ছায়ায় বসে, শুয়ে গা এলিয়ে একটু ক্লান্তি দূর করে নিলাম। বটগাছের মোড় থেকে উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখি বাস চলাচল করছে। তাই দাখে স্বস্তি ফিরে এলো। ক্ষিরা বিক্রেতার কাছে বগুড়া যাওয়ার রাস্তা কোন দিকে জানতে চাইলাম। ক্ষিরা বিক্রেতা সোজা পথ দেখিয়ে জানালো তিন কিলো উত্তর-পশ্চিমে  গেলে  নগরবাড়ি –বগুড়া মহাসড়কে  মির্জাপুর হাট পাওয়া যাবে , তারপর শেরপুর হয়ে মাঝিরা ক্যন্টনমেন্ট তারপর  বগুড়া ,তা অনেকদুর  যেতে হবে ।  বগুড়া যেতে অনেক রাত হবে।আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বগুড়া গিয়ে অধ্যাপক আব্দুল হামিদ টি কে এর বাসায় গিয়ে থাকবো।  এদিকে বেলা প্রায় পশ্চিমে লাল  ধরতে শুরু করেছে। দুঃশ্চিন্তা ধরে গেল। বগুড়া যেতে যদি অনেক রাত হয়, তহলে আমরা কোথায় থাকবো ! এ সময় আমার মনে হলো , আমার নিকট আত্মীয় জ্যাঠাতো বড় ভাই  এবং সহপাঠী খলিলুর রহমান মাঝিরা ক্যান্টনমেন্টে সিএমএইচ -এ আছে। সেখানে থাকা যেতে পারে। আবুল-কিরণও  রাজি হলো।

আল্লাহর নাম নিয়ে আবারও সাইকেল চালানো শুরু করলাম। ২/৩ কিলো যেতেই মির্জাপুর  মহাসড়কে উঠলাম। এদিকে সন্ধ্যা  ঘনিয়ে এসেছে। মির্জাপুর বাজারে নেমে সড়কের ধারে একটি ষ্টলে নেমে পা রুটি আর চা খেয়ে কোনমতে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করে আবার যাত্রা শুরু  করলাম। তিনজনের পায়েই আর শক্তি পাচ্ছেনা সাইকেলে প্যাডেল মারার।  পাকা সড়কে আবার  একভাবে প্যাডেল মারলে পা ধরে যায়।  তবুও বিরিতিহীন সাইকেল চালিয়া শেরপুর পার হয়ে রাত ৮ টার দিকে মাঝিরা সেনানিবাস  পেলাম। সেনানিবাসের বাজারে নেমে একজন মিলিটারিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম  সিএমএইচ এর লোকেশন। এদিকে হঠাত করে এত রাতে এসে ক্যান্টনমেন্টে  ঢুকা এবং কাংখিত খলিল আছে কি না  তা ভেবে ভয়ে দুরু দুরু আতংক নিয়ে সিএমএইচ এর অভ্যার্থনা কক্ষে গিয়ে আমাদের পরিচয় দিয়ে খলিল আছে কিনা জানতে চাইলাম। রিসিপ্সনিষ্ট জানালেন , নাটোরের গুরুদাসপুরের খলিল সাহেব আছেন।তিনি খলিলকে খবর দিলেন। খলিল এসে আমাদের দেখে চমকে উঠলো। এত রাতে কোথা থেকে  কি ভাবে এখানে ।নানা প্রশ্ন। আমরা সংক্ষেপে  জানালাম। তারপর আমাদের সাইকেল রাখার ব্যবস্থা করে নিজ ব্যারাকে নিয়ে গেল। ব্যারাকের অন্যান্যদের সাথ আমাদের পরিচয় করে দিল।সবাই আমাদেরকে ভাই হিসেবে সম্মানের সাথে অভ্যার্থনা জানালেন। আমাদের বগুড়া আসার কাহিনি শুনে সবাই হতবাক হলেন। প্রথমেই ব্যারকেই আমাদের চা-নাস্তার ব্যবস্থা করলেন।  আমরা ফ্রেস হলাম।আর্মিদের খাবার আগেই দেয় তাই, রাতের খাবার  বাইরে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালো খলিল। খেয়ে ব্যারাকে আসলাম।  খলিল জানালো , রাতে ব্যারাকে বিনোদন হবে, আমরা যাব কিনা? আবুলতো  যাওয়ার জন্য অতি উতসাহী। আমি , কিরণও বাদ যাই কেন? খলিলের সাথে বিনোদন রুমে গেলাম। খলিল আমাদের উপস্থিত সবার সাথে পরিচয় করে দিল ভাই এবং সাংবাদিক হিসেবে। সাংবাদিকের পরিচয় পেয়ে সবসি আমাদের সমিহ করতে লাগলেন। আমরাও বিনোদনে অংশ নিতে চাই নাকি জানতে চাইলে আবুল দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল। আবুলকে বাদ্যযন্ত্র  এগিয়ে দিল । আবুল  যা পাড়লো তাই গাইলো। বাদ্যযন্ত্রও বাজালো। এমন ভাব যেন আমি সব পাড়ি।আমি ,কিরণ ভাঙ্গ ভাঙ্গা  কন্ঠে অংশ নিলাম। এরপর ফ্লোরে বিছানায় গিয়ে গনবিছানায়  ক্লান্তির শরীর ছেড় দিলাম। একটু ঘুম ঘুম এসেছে  এমনসময় চাঁচকৈড়ের মক্কেল মিলিটারি ( আমিন ও মাসুদের আব্বা) খলিলের কাছে খবর পেয়ে ছুটে এসে আবুল আর কিরণকে ডাকছেন।মক্কেল মিলিটারি আবুল- কিরণকে চিনেন  আমাকে সেভাবে চিনেননা। আমার পরিচয় দিতেই চিনলেন। বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক বললেন  । দীর্ঘ পথ সাইকেল চালিয়ে আসায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতে  যেতে চাইলামনা, খলিলও যেতে দিতে চাইলোনা। তবে পরদিন সকালে তাঁর বাসায় যাওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে চলে গেলেন।

পরদিন সকালে ঘুমথেকে  উঠে খলিল তার ডিউটিতে গেল। মক্কেল মিলিটারি সকালে এসে আমাদেরকে  বাসায়  নিয়ে গেলেন।  ক্যান্টনমেন্টের   সংলগ্ন মহাসড়কের উত্তর পাশেই বাসা। বাসায় যেয়ে মক্কেল মিলিটারির ছেলে মাসুদ, আমিনদের সাথে  পরিচয় হলাম। তখন আমিনরা ছোট ছিল। ভাবি গরুর মাংশ, মুরগির মাংশ, খাসির মাংশ, রুইমাছ, ছোট মাছসহ নানা পদের তরকারি রান্না করে আমাদের অত্যন্ত যত্নসহকারে খাওয়ালেন। আমাদেরকে থাকার জন্য পিড়াপিড়ি করলেন।কিন্তু আমরা বগুড়া যাব ।কখন ফিরবো ঠিকনাই।  সবার কাছ থেকে বিদায়  নিয়ে বাস ষ্ট্যান্ডে এসে বাসে  চড়ে বগুড়ার সাতমাথায় নামলাম।সাতমাথা থেকে রিক্সায় আজিজুল হক কলেজে গেলাম। গেটে গিয়ে নেমে গেট সংলগ্ন পোষ্ট  অফিসে ঢুকলাম । পোষ্টমাষ্টারের কাছে জানতে চাইলাম অধ্যাপক আব্দুল হামিদ টি কে আছেন কিনা।কারণ আমাদের ধারণা যে,  অধ্যাপক আব্দুল হামিদের সাথে পোষ্ট অফিসের যোগাযোগ ছিল অস্বাভাবিক। প্রতিদিনই পোষ্ট অফিসে তিনি চিঠি পাঠাতেন এবং তাঁর নামে বহু চিঠি আসতো। আব্দুল  হামিদের কথা শুনেই পোষ্টমাষ্টার শ্রদ্ধাভরে হা্মিদ স্যারের অনেক প্রশংসা করলেন। ফোনে পোষ্টমাষ্টার  আমাদের আগমনের কথা জানালেন। আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি একজন পিয়ন পাঠালেন। পিয়ন এসে আমাদের সাথে করে নিয়ে ওয়েটিং রুমে বসতে দিয়ে খবর দিলেন। ইতমধ্যে চা-বিস্কুট দিয়ে গেছে পিয়ন। আমরা চা খাচ্ছি এরমধ্যে শ্রদ্ধাভাজন  হামিদ স্যার ধবধবে সাদা পাজামা আর পঞ্জাবি পড়ে আমাদের কাছে হাস্যজ্জল মুখে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে স্নেহের পরশে সিক্ত করলেন। আমরা আপ্লুত হয়ে পড়লাম। চেম্বারে নিয়ে বসে আমাদের বগুড়ায় আগমনের তিনজনের এডভেন্সারের কথা  শুনে বিস্মিত হলেন। ইতমধ্যেই বগুড়ার নামকারা সিঙ্গরা, কেক, চা  চলে এলো। আমি এখনো সাংবাদিকতা শুরুই করিনাই। কেবল এইচএস সি পরিক্ষা দিয়েছি। কিরন-আবুল আগে থকেই  সাংবাদিকতা করে। তাই আবুল আর কিরণকে হামিদ স্যার আগে থেকেই চিনেন। হামিদ স্যারের হাত ধরেই কিরণ আবুলের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি।  আমি আব্দুল জাব্বার মাষ্টারের ছেলে পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হলেন। তিনি আমাকেও সাংবাদিকতা করার উতসাহ দেন। আমি আগ্রহ জানালে তিনি আরও খুশি হয়ে বললেন, ‘সাতমাথায় দৈনিক উত্তরবার্তা পত্রিকা বের হয়। প্রকাশক ও সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান টোকন  আমার ছাত্র। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। আমার কথা বলো।‘ বলেই উত্তরবার্তা পত্রিকার  সম্পাদক মাহাবুব ভাইকে ফোন করে আমাদের  কথা বললেন। । এছাড়া দৈনিক করতোয়া এবং দৈনিক উত্তরাঞ্চল পত্রিকা অফিসেও যেতে বললেন। পত্রিকা অফিস থেকে  কাজ সেরে কলেজে আসতে বললেন ,বাসায় দুপুরে খাওয়ার জন্য।

আমরা প্রথমে বগুড়ার ঐতিহাসিক সাতমাথায় গিয়ে উত্তরবার্তা পত্রিকা অফিস খুঁজে  ঢুকলাম জীর্ন   এক পুড়ানা বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে। বিল্ডিংয়ের দোতালায় বগুড়া প্রেসক্লাব। পত্রিকা অফিস পরিত্যক্ত টিনসেড ঘরের টিনের বারান্দায় বেড়া দিয়ে ঘেরা। দেখি ২/৩ জন  বসে আছেন। একজন ছিলেন বয়স্ক ভাবগম্ভির মোটাসোটা ব্যাক্তি। আমাদের পরিচয় দিলাম । সম্পাদকের সাথে দেখা করতে চাইলে আমাদেরকে সম্পাদক মাহাবুব  ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। আমরা নিজ নিজ পরিচয় দিলাম । সম্পাদক নিজের নাম ও পরিচয় দিয়ে জানালেন,  স্যার আপনাদের কথা ফোনে জানিয়েছেন। ইতমধ্যে আমাদের জন্য চা-সিংগারা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। এসময়ে আমাদেরকে কলামিষ্ট বুদ্ধিজীবি সেই ভাবগম্ভির মানুষ মতিন খালু ( সম্পাদকের খালু), বার্তা সম্পাদক  প্রদীপ ভট্রাচার্য শংকর দা,  সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার  আশিষ উর রহমান শুভ , বিজ্ঞাপন ম্যানেজার হামিদ ভাই  এবং সার্কুলেশন ম্যানেজা আবু বক্কার সিদ্দিক ও অন্যান্যরদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা চলনবিলের  কৃতিসন্তান প্রফেসর আব্দুল হামিদ স্যারে এলাকার হওয়ায় খুব সম্মান করলেন সবাই। বগুড়ার মানুষ অধ্যাপক আব্দু হামিদ স্যারকে শুধু চলনবিলের প্রখ্যাত মানুষ বা শিক্ষাবিদ নয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যক বলে পরম শ্রদ্ধার সাথে  সম্মান করে।সম্পাদক,  শংকর দা এবং শুভ হামিদ স্যারের ডাইরেক্ট শিক্ষক । প্রত্যেকেই হামিদ স্যারকে শ্রদ্ধা করেন দেখে আমরা গর্বিত হলাম। আমাদের মধ্য থেকে কিরন এবং আবুল  আমাকে এই পত্রিকায় লাখার জন্য বলে। আমিও রাজি হয়ে যাই। সম্পাদক  মাহবুব ভাই আমাকে সংবাদ লেখার কিছু দিক নির্দেশনা দিলেন। আমিতো সংবাদ লেখার কিছুই বুঝি্না, তবুও সম্পাদকের কথাগুলি মনযোগ সহকারে শুনলাম। আমার  নাম, ঠিকানা বার্তা সম্পাদক শংকর দা লিখে রাখলেন। এদিকে অত্যন্ত রাসভারি গুরুগম্ভির  বুদ্ধিদিপ্ত কলামিষ্ট আব্দুল মতিন খালু (আশিষ উর রহমান শুভর বাবা এবং সম্পাদক মাহবুব ভাইয়ের খালু)   আমাকে সংবাদ এবং ফিচার লেখার কিছু ট্রপিকস দিলেন। চলনবিলের ইতিহাস,- ঐতিহ্য,সমস্যা- সম্ভাবনা, প্রয়োজনীয় সুপারিশ,সাক্ষাতকার চলনবিলের গুনীজনদের জীবন ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ করে লেখার গাইডলাইন দিলেন। আমরা  উত্তর বার্তা পত্রিকার কয়েক কপি নিয়ে দৈনিক উত্তরাঞ্চল পত্রিকা অফিসে গেলাম। উত্তরাঞ্চল প্ত্রিকার সম্পাদক প্রবিন সাংবাদিক দূর্গাদাস মুখার্জীর সাথে সাক্ষাত করলাম। আমাদের পরিচয় দিতেই  তিনি জানালেন, হামিদ সাহেব আমাদের কথা জানিয়েছেন। আমাদের সিংগারা –চা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। কিরন এই পত্রিকায় চলনবিলের সংবাদ দাতা হিসেবে লিখতে আগ্রহ জানালে সম্পাদক অ ত্যন্ত খুশি হলেন। চলনবিলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে লেখার জন্য পরামর্শ দেন। তিনি কিছু পত্রিকাও দিলেন। এর পর আমরা গেলাম করতোয়া পত্রিকা অফিসে গিয়ে সম্পাদকের সাথে দেখা করলাম। এখানেও  চলনবিল আর হামিদ স্যর পাঠিয়েছেন শুনে অত্যন্ত সম্মানের সাথে কথাবার্তা বললেন। তখন করতোয়া পত্রিকায় আতহার লিখতেন ( আতহার তখন  প্রেসক্লাব থেকে বহিস্কার ছিলেন)। সম্পাদক হেলালুজ্জামা তালুকদার আতহারের খোঁজ খবর নিলেন। কিরণ আর আবুল  আতহারের বহিস্কারের ঘটনা চেপে যায়। আমি আতহারের বিষয়ে কিছুই জানিনা। করতোয়া পত্রিকা থেকে বের হয়ে সোজা আজিজুল হক কলেজে চলে এলাম। বেলা তখন প্রায় ৩ টা। হামিদ স্যার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের নিয়ে বসায় গেলেন। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে অনেক কথা হলো হামিদ স্যারের সাথে। বাসা থেকে বের হলাম ৫ টার দিকে। বগুড়া থেকে বাসে মাঝিরা ক্যন্টনমেন্টে ফিরে আসি। খলিল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাত ৯ টার দিকে মক্কেল মিলিটারি এসেছেন  রাতের খাবারের জন্য  আমাদেরকে নিতে। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে আবার ক্যান্টনমেন্টে এসে আড্ডা মেরে রাত ১২ টার সময় বিছানায় ঘুমিয়ে গেলাম।

ভোরে উঠে নাস্তা সেরে  সাইকেল নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে  বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মাঝিরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওয়ানা হয়ে মহাসড়ক হয়ে বগুড়া জাহাঙ্গির নগর এসে নাটোর মহাসড়কে  উঠে নাটোরের দিকে সাইকেল চালানো শুরু করলামা। পথে মাঝে মাঝে বাজার বা চা ষ্টল দেখে থেমে চা-বিস্কুট খেয়ে  জিরিয়ে নিয়ে আবার সাইকেল চালানো শুরু করতাম। এইভাবে চলতে চলতে  নন্দিগ্রাম,  ওমরপুর , রনবাঘা , জামতলি , চৌগ্রাম পার হয়ে সিংড়ার কাছা কাছি আসতেই আবুলের সাইকেলের ডান প্যাডেলের  পা দানি গেল ভেঙ্গে।এদিকে সড়কের ধারে কোন সাইকেল মেকারও নাই। আবুল ছিল সাহসি এবং গোঁয়ার এক রোখা প্রকৃতির। প্যাডেল ছাড়াই চালাতে শুরু করলো। ওর জেদ প্যাডেল ছাড়াই চালিয়ে যাবে। এভাবেই সিংড়া এসে নদিতে ফেরি পাড় হয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে কলম। শাঁঐল, সোনাপুর দিয়ে কুমারখালি খেয়াঘাটে  খেয়া নৌকায়  পাড় হয়ে নাজিরপুর হাটে নামলাম । তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা হবে।  দীর্ঘ  পথ একটানা  সাইকেল চালিয়ে তিনজনেরই অবস্থা কাহিল। প্যাডেল ছাড়া সাইকেল চালায়েও আবুল যেন ক্লান্তই হয়নাই এমন ভাব করছে।  নাজিরপুর বাজারে হোটেলে কিছু খেয়ে ক্লান্তি দূর করে আবারও সাইকেলে উঠে প্রায় ১২ কিলোমিটার  কাঁচা রাস্তার ধুলা ঠেলে রাত ৯ টায়  চাঁচকৈড় পৌঁছালাম। চাঁচকৈড় এসে তিনজন কার্তিকের হোটেলে সিঙ্গাড়া ,চা খেলাম। আবুল ,কিরণ  থেকে গেল । আমি রাতের  ঘুটঘুটে অন্ধকারে গাড়িষাপাড়া হয়ে  কালিনগর-সাহাপুর নদির ধার দিয়ে সাইকেল চালিয়ে শিকারপুর বাড়িতে পৌঁছালাম ।তখন রাত প্রায় ১১ টা।  বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার  যাওয়ার শব্দ পেয়ে মা চুপ করে  বাইরে এসে আমার ঘরে খাবার দিয়ে চলে যায়।আর সাবধান করেদেয়,চুপ করে খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে। আর বলে ,’ তুই না কয়ে এ কয়দিন কোথায় গেছিলি? সব জায়গায় খোঁজ করে কোথাও না পেয়ে কান্নাকাটি  করছে সবাই। তোর বাপ খুব রেগে আছে।তোর জন্যে খাওয়ার দিতে মানা করেছে।  এখন জানতে পারলে তোকে আস্ত রাখবেনা। আল্লাহ জানে সকালে কী হবে! আমি চুপ করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভাগ্য ভালো , সকালে আমার ছোট দাদা নওশের ডাক্তার মশিন্দা থেকে আমাদের বাড়িতে আসায় আব্বার শাস্তি থেকে রেহাই পেলাম।‘

মোঃ আবুল কালাম আজাদ, প্রবিন সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, চলনবিল প্রেসক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি, গুরুদাসপুর, নাটোর।