ফারুক আহম্মেদ জীবন এর “মুক্তি যুদ্ধের এক রাতের গল্প”

ফারুক আহম্মেদ জীবন /
বিজয়ের একমাত্র ছেলে স্বাধীন। এবছর বয়স আট এ পড়েছে। এখন সে তাদের মধুপুর গাঁয়ের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ছে। সে ক্লাসে তার মাস্টারদের মুখে শুনেছে এই ডিসেম্বার মাস নাকি বাঙালীদের বিজয়ের মাস। এই মাসে বাঙালীরা বিজয় লাভ করেছিল। আর তাই প্রতি বছর এ মাসের ষোল তারিখে স্কুলের শিক্ষক- শিক্ষিকারা ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে স্কুলের সামনের মাঠ প্রাঙ্গণে। অতি জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সকল ছাত্র- ছাত্রীদের অভিভাবক এবং এলাকার গণ্য মান্য ব্যক্তি বর্গদের উপস্থিতিতে।
লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করে মহা আনন্দে
বিজয় দিবস পালন করে। স্বাধীনদের স্কুলে আগামীকাল সকালে সে বিজয় দিবস অনুষ্ঠানের দিন। রাতে স্বাধীন তার দাদি জয়তুন নেছাকে কে জিজ্ঞাসা করলো। আচ্ছা দাদি, বিজয় দিবসটা কি?
কেনো আমরা বাঙালীরা সবাই ১৬ই ডিসেম্বরে এটা পালন করি? তখন সেখানে এলো স্বাধীনের মা জ্যোতি। বললো কি ব্যাপার মা, আপনার পুতা স্বাধীন কি জিজ্ঞাসা করছে আপনার কাছে? জয়তুন নেছা বললো, আমার দাদু ভাই আমার কাছে বিজয় দিবস সম্পর্কে জানতে চাইছে বউমা।
জ্যোতি জানে, মুক্তি যুদ্ধের কথা মনে উঠলে তার শাশুড়ীর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ছানি পড়া তার ঝাপসা দুটি চোখে জল টলমল টলমল করে। আর সেটা যে হওয়ারই কথা কেননা….
এই মুক্তি যুদ্ধের জন্যই যে তার শাশুড়ী স্বামীকে
হারিয়ে খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিল। জ্যোতি বললো, বাবা স্বাধীন এসো তোমার দাদিকে বিরক্ত কোরোনা। বিজয় দিবস নিয়ে আমি তোমাকে না হয় অন্য একদিন বলবো। তুমি আমার কাছ থেকে শুনে নিও। স্বাধীন গাল ফুলিয়ে আরো বেশি জেদ ধরে তার দাদি জয়তুন নেছাকে জড়িয়ে বললো না, আমি আমার দাদির কাছ থেকে শুনবো আম্মু।
জয়তুন নেছা স্বাধীনের সারা মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে থুতনি ধরে চুমু খেয়ে বললো। আচ্ছা ঠিক আছে দাদু ভাই, আমি তোমাকে আজ বিজয় দিবস সম্পর্কে বলবো। তারপর বউমা জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বললো, আমার দাদু ভাই যখন এত করে শুনতে চাচ্ছে, তখন বলি না বউমা। দাদু ভাইও একটু জানুক।
আর তাছাড়া ওরা বর্তমান প্রজন্মের শিশু। ওরাই তো আগামীদিনে এই দেশের হাল ধরবে। কত রক্তে অর্জিত এ দেশ, এদেশের স্বাধীনতা। মুক্তি-
যুদ্ধের ইতিহাস ওরা না জানলে। এদেশ, এদেশের মানুষ, মাটি, পূর্ব বাংলার নেতা বাঙালীদের জনক
বঙ্গবন্ধুর প্রতি ওদের ভালোবাসা জন্মাবে কিভাবে?
তাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ওদেরও যে জানা খুব দরকার বউমা। জ্যোতি, বললো, হুম তা অবশ্য আপনি ঠিক বলেছেন মা।
ততক্ষণে স্বাধীনের আব্বু বিজয় তার দোকান বন্ধ করে বাজার থেকে বাড়ি ফিরেছে। বিজয় একজন মুদী ব্যবসায়ী। গ্রামের বাজারেই তার দোকান। ছেলে স্বাধীন, বিজয়কে দেখেই বললো আম্মু, ঐ যে আমার আব্বু বাড়ি এসেছে।
বৃদ্ধা মা জয়তুন নেছা বিজয়কে দেখে বললো খোকা, এসেছিস বাবা?
বিজয়, হ্যাঁ মা, এইতো এই মাত্র এলাম।
জয়তুন নেছা,এত রাত করিস কেনো বাবা? দোকানটা বন্ধ করে একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারিসনা?
বিজয় বললো, মা গ্রামের বাজার, এর চেয়ে তাড়াতাড়ি আসলে যে বেচাকেনা কম হবে। তাছাড়া বাজার শেষের দিকে দোকান বন্ধের সময় লোকজনে বেশি ভীড় করে তাই….
জয়তুন নেছা, হুম তা অবশ্য ঠিক বলেছিস বাবা।
দোকানের আয়ের পরেই তো এ সংসারটা চলে।
বেচাকেনা না করলে চলবে কি করে?
আসলে বৃদ্ধ মা জয়তুন নেছার কাছে বিজয় অন্ধের যষ্টির মত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে তার স্বামী জয়কে হারিয়ে। ছেলে বিজয়ের জন্মের পর ছেলেকে অবম্বন করেই। আর দ্বিতীয় বিয়ে না
করে আজো স্বামীর ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছে। বিজয় ছাড়া তার সাত কুলে যে কেউ ছিলো না। তাইতো বিজয় চোখের আড়াল হলে মা জয়তুন নেছার দুঃশ্চিতার অন্ত থাকে না। বিজয়ও তার মাকে খুব ভালোবাসে।
জয়তুন নেছা বললো, তা- হ্যাঁ বৌমা যাও বিজয়-কে খেতে দাও…
জ্যোতি বললো, জ্বি, দিচ্ছি মা।
তারপর জ্যোতি বিজয়কে বললো, কাপড়চোপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে এসো। আমি তোমার খাবার দিচ্ছি।
বিজয়, আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে বললো কি বাবা স্বাধীন। তুমি খেয়েছ? স্বাধীন বললো, হুম খেয়েছি আব্বু।
বিজয়, তাহলে এখনো জেগে কেনো? ঘুমিয়ে পড়ো।
জ্যোতি, তোমার ছেলের মাথায় স্কুলের মাস্টাররা
বিজয় দিবসের পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর তাই ওর দাদির কাছ থেকে বিজয় দিবস সম্পর্কে শুনবে বলে এখনো না ঘুমিয়ে জেগে আছে।
বিজয়, ও আচ্ছা তাই বলো.. তারপর বিজয় কাপড়চোপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে এসে  বারান্দায় খেতে বসলো। জ্যোতি খাবার এনে বেড়ে দিতে লাগলো। বিজয়ের খাওয়া শেষ হতেই। স্বাধীন বললো কি হলো দাদি এবার বলো?
জয়তুন নেছা বললো হুম, তাহলে বলছি শোনো দাদু ভাই। তারপর কল্পনায় বলতে শুরু করলো। তখন ছিল ১৯৭১ সাল পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে
পূর্ব বাংলার মানুষের পরক্ষে পরক্ষে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। কোন ভাবেই সে বিবাধ মিটছেনা।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকা রেসকোর্সের ময়দানে এক
বিশাল জনসমাবেশের ডাক দিল। সেই জনসমুদ্রে
ভাষণে সর্ব প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিল। বললো
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
আপনাদের যার যা-কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
তার কিছুদিন পরেই ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। তারপর মধ্য রাতে ঢাকা শহরে অতর্কিত ভয়াবহ হামলা চালিয়ে নির্বিচারে বহু মানুষকে গুলি করে মেরে ফেললো। এ খবর ছড়ানো মাত্র সারা পূর্ব বাংলা জুড়ে বেজে
উঠে যুদ্ধের ডামাডোল। দলেদলে বাঙালীরা মুক্তি
বাহিনীতে নাম লেখায়। আবার কেউ কেউ পাকি
বাহিনীর দোসর হয়ে। নিজেদের ফায়দা লুটতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস সেজে আমাদের শত্রু ঐসব খানেদের সাহায্য করে। ওরা
একের পর এক গ্রামের পর গ্রাম বাঙালীদের ঘর-
বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বহু লোক বাড়িঘর ফেলে
প্রাণ বাঁচাতে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। ভারত সরকার সেই দুর্দিনে পাশে দাঁড়ায়। মুক্তি বাহিনীদের খাওয়া থাকা ও যুদ্ধের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে। তোমার দাদুও মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখায়। তখন তোমার আব্বুর জন্ম হয়নি। বলতো জয়তুন আমি যদি যুদ্ধে শহীদও হয় বেঁচে নাও থাকি। দেখবে একদিন এদেশ স্বাধীন হবেই। তখন তোমার পেটে আমার যে সন্তান। তা যদি ছেলে হয় নাম রাখবে বিজয়।
আর যদি মেয়ে হয় নাম রেখো মুক্তি কেমন। যুদ্ধ চলাকালীন একদিন তোমার দাদু গোপনে আমার সাথে দেখা করতে বাড়িতে এলো। কিভাবে জানিনে সেই খবর রাজাকার-রা জেনে গেলো।
ঐ রাতে ওরা খাঁন সৈন্যদের নিয়ে এ গ্রামে ঢুকলো। গভীর রাত চারিদিকে গুলির বিকট শব্দ।
মানুষের কান্নাকাটির আওয়াজ। জানালা দিয়ে
দূরে তাকিয়ে দেখি মানুষের ঘর পুড়ছে। চোখের
পলকে মিলিটারিরা আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেললো। তোমার দাদু মেশিনগান তুলে নিলো হাতে। আমাকে বললো জয়তুন আমার সন্তানের
কসম। তুমি আমার সন্তানটিকে বাঁচাও। যাও যাও
তুমি বাড়ির পিছন দিক দিয়ে দূরে পালিয়ে যাও।
আমি বললাম আর তুমি? আব্বা, মা? তোমার দাদু বললো, জয়তুন আব্বা, মা, বয়স্ক মানুষ দৌড়াতে পারবেনা। আর আমার কথা বলছো? ভীরু কাপুরুষেরা শত্রু দেখে ভয়ে রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে যায়। একজন মুক্তি যোদ্ধা নয় জয়তুন।
আমি যদি পালিয়ে যায়, তাহলে যে সমস্ত মুক্তি
যোদ্ধাদের অপমান করা হবে। তুমি যাও আমি
আব্বা মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। তারপর ইচ্ছা
না থাকা সত্ত্বেও তোমার দাদুর দেওয়া কসমের
জন্য শেষে আমি পালাতে বাধ্য হয়। শুনেছি দীর্ঘ সময় তোমার দাদুর সঙ্গে ওদের যুদ্ধ হয়েছিল।
তোমার দাদুর সহযোদ্ধারাও খবর পেয়ে তোমার দাদুকে বাঁচাতে এসেছিল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এসে
দ্যাখে রক্তাক্ত অবস্থায় তিন তিনটে লাশ পড়ে আছে। আমিও ভোর হতেই বাড়িতে আসি। সকালে তোমার দাদু, তার মা, বাবা, তিন জনকে
গ্রাম বাসীরা দাফনের ব্যবস্তা করে। এভাবে নয় মাস যুদ্ধ চলে। ত্রিশ লক্ষ পুরুষ আর প্রায় দুই লক্ষ নারী শিশু এ যুদ্ধে শহীদ হয়। এভাবে যুদ্ধ চলতে চলতে তারপর একসময় আসে ১৬ই ডিসেম্বর। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা বাঙালী বীর মুক্তি যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমার্পন করে পরাজয় স্বীকার করে লেজ গুটিয়ে এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। আর পূর্ব বাঙালীরা সেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। এই দিনেই বিজয় আসে বলে। সবাই এদিনটিকে বিজয় দিবস বলে দাদু। আর এজন্যই বাঙালীরা সকলেই ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবস পালন করে।