শারদীয় দুর্গোৎসব ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

প্রভাষক অরুন কুমার বিশ্বাস /

“পথ বেধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
সেই অক্ষয় তিথি চির অক্ষয় হোক”
মনিষীর এ কাব্যিক ভাবনার মধ্যে যেন মিলনের সুরের মূর্চ্ছনের গন্ধ পাওয়া যায়, অসাম্প্রদায়িক মনের আভাস পওয়া যায়, শেষে চির বন্ধন অটুটের কথা শোনা যায়। সত্যি চিরন্তন বানীগুলি জাতি, ধর্ম, বর্ণ কে এক কাতারে এনে মিলনের ভজন সঙ্গীত মাতিয়ে তোলে।
শরৎকালে বঙ্গদেশে কাশফুলের বন্যা শুরু হয়ে যায়। আবার প্রাকৃতিক খামখেয়ালি পনায় কর্দমাক্ততার আভাস ও কম যায়না, নীল চন্দ্রিমাগুলি ঝকঝকে নীলাকাশে খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে মানুষকে আশার বানী শোনায়, মাঝে মাঝে কুয়াশায় হালকা ধোঁয়া ও অনুভ’ত হয়, প্রাকৃতিক এ প্রানোচ্ছল মুখবয়বে মনে হয় প্রকৃতিতে কারও শুভাগমন ঘটবে। হ্যাঁ প্রকৃতি ও প্রকৃতির জীবজন্ত আমাদের অনেক আগাম সংবাদ জানিয়ে দেয়। তবে এগুলো বোঝার জ্ঞান শক্তি বিদ্যমান থাকলে অনেক দুর্যোগ থেকে অব্যহতি পাওয়া সম্ভব। ভুমিকম্প সহ বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বে বনে বনে জীব জন্তুগুলি ছুটাছুটি করে। যেমন সুনামির আগে অনেক বন্য পশু ঐ এলাকা থেকে চলে গিয়েছিল। এমন তথ্য অনেক আছে। যার আগমনীতে আগাম বার্তায় প্রকৃতিতে আনন্দের তরঙ্গ হিল্লোল বহিতে থাকে, তিনি হলেন মহাশক্তি, মহামায়া, দূর্গতিনাশিনী মা দূর্গা। বেদে যিনি অদিতি, গৌরি, উমা উপনিষদে যিনি ব্রক্ষবিদ্যা উমা, হৈমবতী কাত্যায়নী, পুরাণে আবার তিনিই দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা। যার আগমনে সারা বিশ্বে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিষেশে বিশ^ মিলন মেলায় মেতে উঠে। মা মাহামায়া প্রলয়কালে হাজির হয়েছেন, বারবার বিনাশ করেছেন অসুরদের, উদ্ধার করেছেন দেবতাদের, তার কাছে প্রার্থনা করেছেন বিষ্ণ, তাকে আকুল হয়ে ডেকেছেন ব্রহ্মা কাতর রামচন্দ্র তাঁকে আহবান করেছেন অকালে। তিনি মাায়ারুপ ধারণ করেছেন, তিনিই শক্তির আধার হয়েছেন, তিনিই আবার দান করেছেন বরাভয়, তিনি যুদ্ধ আর মৃত্যুর উপত্যকায় আশ্রয় হয়েছেন দেবালোকের।
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরুপেণু সংস্থিতা
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমোঃ নমোঃ
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ মন্ত্র উচ্চারণে যেন শক্তি ফিরে পায়। এ মন্ত্রে মহাশক্তি নিশ্চিত, শুদ্ধাচারে এ মন্ত্র উচ্চারণ করলে এর তেজ অনুভব করা সম্ভব। মহালয়ার রজনীতে মা শক্তিরুপাকে আবাহন করা হয় এ মন্ত্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আত্ননিবেদন করে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির আগমন ঘটাতে মা আসেন ভক্তদের মাঝে। তাই দেবী দুর্গা পুজিত হন যুগে যুগে আর তার বেদীমূলে প্রতিবছরই আমাদের নতুন করে প্রতিজ্ঞাপন গ্রহন করতে হয়। সনাতন ধর্মে পূজা অর্থ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। তাই দেবতার আরাধনা করতে গিয়ে যেমন জপ, মন্ত্র এবং আনুসাঙ্গিক অঙ্গন্যাসাদি করতে হয়। পূজার এ উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন দ্রব্যাদি ও শ্রদ্ধাসহকারে মন্ত্রোচ্চারণ করে নিবেদন করতে হয়, পূজার এসব উপকরণ সবই প্রকৃতি প্রদত্ত্ব। যেমন জল, ফুল, বেলপাতা, তিল, তুলসী, দূর্বা, চন্দন, আতব চাউল, কলা ও অন্যান্য ফলাদি। পূজার তিথী মাস নির্ধারিত হয় বিভিন্ন দেবদেবীর এই প্রকৃতি প্রদত্ত¦ পূজাপকরণ সহজ লভ্য সময়ে। তাই এ কথা নির্দ্দিধায় বলা যায় যে দেবদেবীর পূজা ও প্রকৃতি পূজার সামিল।
বঙ্গদেশে প্রথম শারদীয়া দূর্গোৎসবের প্রচলন শুরু করেন রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ন রায় বাহাদুর। ৮৮৭ বঙ্গাব্দে (১৪৮০খ্রিঃ) তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ন রায় বাহাদুরের আহ্বানে ‘মা দুর্গা’ সাধারন্যে আবির্ভূত হন। এই পণ্যূভূমিতে রাজা তৎকালীন সময়ে মা’র পুজায় প্রায় নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন।
তিনি একমাস ব্যাপি মহা ধুমধামের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক শারদীয় দুর্গোৎসব করেন। পূজায় পৌরহিত্য করেছিলেন বাবু রমেশ শাস্ত্রী। এই পূণ্যভূমি থেকেই শারদীয় দূর্গোৎসবের সূচনা হয় এবং তখন থেকেই সারা বিশে^ সকল সনাতন সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে শারদীয় দূর্গোৎসব শুরু হয়। রাজা পূজা ক্রমে বারোয়ারী পূজা রুপে সর্বসাধারনের মধ্যে দুর্গোৎসব রুপ লাভ করে। রাজশাহীর পুঠিয়া থেকে ১৫ কিঃ মিঃ উত্তরে ঐতিহাসিক এ মন্দিরটি অবস্থিত। বর্তমান সভাপতি শ্রী নিশীথ কুমার সাহা এবং সাধরন সম্পাদক শ্রী কার্তিক চন্দ্র সাহা। স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির সর্বাঙ্গে শ্রদ্ধার পাত্রী হিসেবে বিবেচনায় আনার জন্যই কুমারী পুজার প্রচলন করে গিয়েছিলেন, ৬ বছরের এক শিশু কন্যাকে উমারুপে পূজা করলেন এবং ভগিনি নিবেদিতাকে বললেন যেদিকে ফিরছি কেবল দেখেছি মায়ের মূর্তি। অষ্টমী পূজা লগ্নে কুমারী পূজা করা হয়। দুর্গা পূজায় শিশু মনের আনন্দ সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “পূজার সাজ ”
কবিতায় লিখেছেন ঃ-
আশি^নের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি ,
পূজার সময় এলো কাছে,
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই ,
আনন্দে দু’হাত তুলে নাচে।
দেবীপূজা মূলত জাতি গঠনের প্রেরণা । সংহতিই জাতিগঠন বা রাষ্ট্রগঠনের মূল ভিত্তি। এই সংহতিকে জাতির কল্যাণে স্বার্থক প্রয়োগই রাষ্ট্র নির্মাণ পূর্ণাঙ্গ হয়।
বৈদিক সূত্রে দেবী নিজেই বলেছেন “অহংরাষ্ট্রী” প্রত্যেক রাষ্ট্রে চার শ্রেণীর মানুষ দেখা যায়। বুদ্ধিজীবি, বীর্যজীবি, বৃত্তিজীবি ও শ্রমজীবি। এ চার শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি ও পরস্পর সাহচর্য যেখানে অবিঘ্নিত সে জাতি বা রাষ্ট্র অপ্রতিহত গতিপথে তার লক্ষ্য অর্জনে সামর্থ। দেবীর দক্ষিনে লক্ষী ও গনেশ এবং বামে সরস্বতী ও কার্তিক। লক্ষী ধনশক্তি, গনেশ জনশক্তি বা শ্রমশক্তি, সরস্বতী জ্ঞানশক্তি এবং দেব সেনাপতি কার্তিক ক্ষাত্র শক্তির দেবতা। দেবীর এ প্রতিমা দর্শনে লব্ধ জ্ঞানই রাষ্ট্রীয় জ্ঞান। বস্ততঃ দুর্গা প্রতিমা, দেবী পূজার সমাজের সকল স্তরের লোকই প্রয়োজন। দশে মিলে কাজ করার, কল্যাণ করার সুন্দর সমাজ গড়ার কাজ নিয়েছেন বলে তিনি দশভূজা, জাতির সকল প্রকার অশুভ বিনাশ করার জন্যই তিনি দশপ্রহরণধারিনী।
বোধনে দেবীর আগমন ঘটে, তারপর ষষ্টী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, বিজয়া দশমী। এত অর্থ ব্যয় করে আনন্দময়ীর অর্চ্চনার ব্যবস্থা করছেন। এতে রোগ, শোক, দুর্ভিক্ষপীড়িত বঙ্গবাসীর অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়াকাশে ক্ষনিক বিদ্যুৎ স্ফুরনের ন্যায় আনন্দময়ীর আগমনে কয়েকদিন আনন্দের বিকাশ ঘটেছিল, কিন্তু আমরা বিজয়ার পর দেবী দূর্গাকে মেয়ে সাজিয়ে বাবার বাড়িতে আসার এক উদ্ভট কল্প কথার গল্প বানিয়ে মহাআড়ম্বরে মাহাধুমধামে উৎসবে দিব্যি সব কিছুকে ভূলে আছি। যা কখনও পূজা অর্চ্চনার কাম্য হতে পারেনা। পূজা অর্চ্চনার যে দর্শন তা আগামী বছর পর্যন্ত মানব জীবনে ধারন করায় যার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে। তবেই দেবী মহামায়ার পূজা করা স্বার্থক। (লেখক- জ্যেতিষশাস্ত্রী ও নির্বাহী সদস্য জোতিষশাস্ত্র গবেষণা সমিতি, পরিচালক, সৌভাগ্য গণনা জ্যোতিষালয়।)