অস্তমিত কাঁসাশিল্পের অনিবার্য বিপর্যয়

রেজাউল করিম খান, নাটোর:

কাঁসারিদের গ্রাম কলম। বহু প্রজন্ম ধরে সেখানে চলে আসছে কাঁসার বাসন তৈরির কাজ। তিনচারজন বাসনশিল্পী বসেন একটি ঘরে। টিন অথবা খড়ের চাল, মেঝের ওপর কোথাও গনগন করছে আগুনের ভাঁটি, কোথাও ধাতুকে ডুবিয়ে ঠান্ডা করার জন্য জলের কুন্ড। তিনগুণের বেশি তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে তৈরি হয় কাঁসা। নরম দুই ধাতু মিলে যখন সংকর ধাতু তামা তৈরি হয় সে অতি কঠিন কাজ, সহজে বাগ মানে না কারিগরের হাতে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে লোহার ছাঁচে ভরে আগুনে ফেলে দেওয়া হয় কাঁসাকে, সে আগুনে বাতাস দেয় হাপর। হাঁ করে হাঁপায় সে। গলন্ত ধাতুকে লোহার ছাঁচ থেকে বের করে কাঠের পাত্রে ঢেলে দেওয়া। সে পাত্রে মাখানো থাকে সরষের তেল। আবার ধাতুকে আগুনে ফেলা হয়, তারপর কঠিন হয়ে গেলে ছেনি আর উকো দিয়ে সমান করে নেওয়া হয় ধার। লম্বা লোহার খন্তা দিয়ে শেষে খসিয়ে নেওয়া হয় তার উপরিতলের আস্তরণ, তাতেই ঝকমকে রঙ পায় পাত্র। ভোর থেকেই আরম্ভ হয়ে যায় মানুষ ও ধাতুর এই অবিরাম সংঘাত, আগুনের ভাঁটি, শীতল জল, হাত ও যন্ত্র যেমন, উকো, ছেনি, খন্তা সবাই মিলে ধাতুকে বাগ মানাতে চায় আর ঠকঠক ঠনঠন ধাতব শব্দের গানে মুখর হয়ে ওঠে পল্লী। কাঁসারি পাড়ায় ধাতুর হৃদয় থেকে উঠে আসা স্বনন পথচারী থেকে মাতৃগর্ভের শিশু, সকলেই অভ্যস্ত হয়ে যায়।
এককালে বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে এক বা একাধিক গ্রামে ছিল কাঁসারিদের বসবাস। নদীতীরবর্তী গ্রামগুলিতে বাণিজ্যতরী যেতো স্বচ্ছন্দে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বণিকের হাকডাক, মজুরের ছুটোছুটি, শান বাঁধানো আসনে মালিক-কারিগরের উপবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হতো পৈত্রিক পেশা রক্ষার শুভযাত্রা। ঘরে ঘরে সাজানো ঝকঝকে কাঁসার সামগ্রী। এমন পসরা দেখে চোখ আটকে যেতো পথিকের। কাঁসার তৈজসপত্রের ব্যবহার ছিল সর্বত্র। পুঁথি-পাঁজিতে লেখা হয়েছে, কাঁসার বাসনে ভোজন স্বাস্থ্যসম্মত। তাছাড়া এতে দাগ ধরে না। কঠিন ধাতু বলে বংশানুক্রমে টিকে থাকে গৃহকোণে, দেবালয়ে। মরিচা ধরে না। অম্ল বস্তুতে বিক্রিয়া ঘটে না। সে এক সুদিন ছিল বটে। মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কত শিল্পীর জীবন। মন্দিরে, রথে, রাসযাত্রায় লাগে কত শত ঘণ্টা। ছোট বড় নানা প্রদীপ একমুখী, দ্বিমুখী, পঞ্চমুখী। নানা দেবদেবী মূর্তিশোভিত দীপদান। গৃহস্থের ঘরে ব্যবহার হত বড় বড় থালা, পূজার, ভোজনের পাত্র, জলের, অন্নের, দেবতার ভোগ সামগ্রীর। কীর্তনের মন্দিরা সেও কাঁসার। মন্দিরে প্রতিমাগুলি কাঁসার। এছাড়াও গৃহসজ্জার নানা সামগ্রী, শাড়ির ঝাঁপি, ধান মাপার পাত্র বা ‘মান’, পুতুল, পাখি, ফুলদানি, বরাহ। পিতল-কাঁসার বাসনপত্র দিয়ে নববধূকে বরণ করা, এসবই শুভ লক্ষণসূচক।
দুই বা ততোধিক ধাতু নির্দিষ্ট পরিমাণে একসঙ্গে গলিয়ে কিংবা দুই বা ততোধিক ধাতুকে পৃথক পৃথক পাত্রে গলিয়ে, গলিত ধাতুগুলিকে পরিমাণ মতো মিশিয়ে সংকর ধাতু তৈরি করা হয় । যেমন দস্তা এবং তামা ধাতু পরিমাণ মতো নিয়ে একসঙ্গে গলিয়ে ঠান্ডা করলে পিতল নামে সংকর ধাতু উৎপন্ন হয় । অনুরূপে তামা এবং টিন ধাতুর মিশ্রণে কাঁসা প্রস্তুত হয় । প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে তামা-কাঁসা-পিতল-লোহা নিয়ে কাজ করেছে মানুষ। তাদের নব নব আবিষ্কারের ফলে নির্মিত হয়েছে সভ্যতা। শিল্পীর কারুকার্যময় সামগ্রী দ্যুতি ছড়িয়েছে বিশ্বময়। এইসব নিয়ে গবেষণা করেছেন অনেকেই, নিবন্ধ লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নব্য প্রস্তর যুগে (৪০০০-২০০০ খ্রিস্ট পূর্ব) মানুষ প্রথম ধাতু হিসেবে তামা ব্যবহার করে। পরবর্তীকালে তারা ব্রোঞ্চ ধাতুর ব্যবহার করতে শেখে। এই সময় মানুষ তামা ও ব্রোঞ্চ দুটো ধাতুই ব্যবহার করতো বলে একে তাম্র প্রস্তর যুগ বলে। সিন্ধু সভ্যতা হল তাম্র প্রস্তর যুগের একটি সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যে প্রস্তর যুগের সমাপ্তি ঘটে। এরপর ব্রোঞ্জ যুগ, তাম্র যুগ এবং লৌহ যুগের শুরু হয়।
পালদের শাসনামলে তামা-কাঁসার ব্যবহার হয়েছে বলে জানা যায়। ৭৫০ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গোপাল গৌড়ে পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। পাল সম্রাটেরা বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন। তারা ছিলেন প্রাজ্ঞ কূটনীতিবিদ ও যুদ্ধজয়ী, ধ্রুপদী
ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিল্পের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। আরব আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক ছিল। তাদের প্রায় চার শ‘ বছরের শাসনামলে বাংলা ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। পাল যুগের প্রাপ্ত অসংখ্য তাম্রলিপিতে বিধৃত ‘প্রশস্তি’ অংশে সংস্কৃত ভাষা চর্চার ও শৈল্পিকমান সম্পন্ন কাব্য রচনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সেন বংশের রাজত্বকালেও এই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। বিজয়সেন সমগ্র বাংলায় প্রায় দীর্ঘ ৬২ বছর (আনু. ১০৯৮-১১৬০ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্ব করেন। সেনরা ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবর্তক। ধাতু দিয়ে তখন ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক, কামান পর্যন্ত তৈরি করা হতো। এরপর ধীরে ধীরে কাঁসা দিয়ে বিভিন্ন দৈনন্দিন নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা শুরু হয়। কাঁসা শিল্প ক্রমে বিস্তার লাভ করে।
কিন্তু সম্প্রতি স্টিল, মেলামাইন, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এই শিল্প ক্রমে বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। সমস্য অনেক, কিন্তু প্রকৃত সমস্যা রাজনৈতিক। যে সররকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তার রাজনৈতিক শ্রেণি চরিত্রের ওপর জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা আবর্তিত হয়। বর্তমানে চলছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুক্তবাজার অর্থনীতি। পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে বাণিজ্য, কারখানা এবং উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে। এই অর্থব্যবস্থায় দেশের সম্পদের অধিকাংশই সমাজের পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। সমাজে আয় ব্যয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ধনীরা আরও ধনী হতে থাকে এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র। বেশি মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎপাদক শ্রেণী শ্রমিকদের শোষণ করে, কম মজুরি প্রদান করে, অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে এবং বেশি শ্রম আদায়ের চেষ্টা করে। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করার নামে ইউনিয়ন, সমিতি, সঙ্ঘ, ফেডারেশন প্রভৃতি সংগঠনের আবরণে দালাল শ্রেণি তৈরি হতে দেখা যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এদের বুদ্ধি ও চিন্তার সংকীর্ণতা, যুক্তিহীন ক্ষমতার আস্ফালন ও শ্রেণিস্বার্থের বিপরীতে অবস্থানের কারণে ক্ষুদ্র পুঁজির স্বাধীন উদ্যোক্তারা হারিয়ে যায়। যেমনটি হয়েছে কাঁসা শিল্পের ক্ষেত্রে।