কাজল রশীদ শাহীন এর গল্প ‘আমি শুধু মোবাইলটা পড়তে দেখেছিলাম’

লোকটার চোখ বাঁধা না খোলা, ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছে না। চোখে হাত দিলেই জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যায়, কিন্তু সেই কাজটিও সে করতে পারছে না। হয়তো ভয়ে কিংবা অভ্যাসবশে। লোকটা যখন এই অভিজ্ঞতার কথা বলছিল, বারবার করে এটাও বলছিল যে, এর মধ্যে বাস্তব ঘটনাই পুরোটা, কিছুটা স্বপ্নদৃশ্য কিংবা কল্পগাথা যুক্ত হলেও হতে পারে। লোকটা বাস্তবটাই শোনাতে চায়, কিন্তু তার সঙ্গে কিছুটা অবাস্তবও হাজির হয়। লোকটা বলছিল এভাবে, তাকে একজন কিংবা তার চেয়েও বেশিজন মিলে প্রশ্ন করেছিল।
আপনি কী দেখেছিলেন?
মোবাইলটা পড়তে দেখেছিলাম। লোকটি সহজভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাস নিয়েই উত্তর দেয়।
আর কিছু দেখেননি? লোকটাকে প্রশ্ন করে একজন। উত্তরের অপেক্ষা না করে প্রশ্ন করতেই থাকে।
আপনি আর কিছুই দেখেননি?
আপনি দেখেননি, ধানমন্ডি লেকের ওই সময়ের কোনো কিছুই?
ছেলে আর মেয়েটা যে জায়গায় বসেছিল, সেখানকার কোনোকিছুই আপনি দেখেননি?
শুধু দেখেছেন ছেলেটা আর মেয়েটার উষ্ণতা বিনিময়? কী ব্যাপার আপনি কথা বলছেন না কেন?
আমরা জানতে চাচ্ছি আর আপনি সম্রাট শাহজাহানের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন?
সম্রাট শাহজাহান কি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন?

এই কথা ঘোরাবেন না বলছি, আপনি দেখেননি তখন জাহাজবাড়িটার পাশ দিয়ে মাহফুজ মিশুকে আসতে?
কোন মাহফুজ মিশু—লোকটি জানতে চায়।
ও মাহফুজ মিশুকে আপনি চেনেন না? আচ্ছা। তাহলে বলুন তো জ.ই মামুনকে আসতে দেখেছিলেন কিনা?
কোন জ.ই মামুন?
ও জ.ই মামুনকেও আপনি চেনেন না?—একজন কিংবা একাধিক জন একসঙ্গে প্রশ্ন করে?
লোকটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

এবার বাজখাই গলায় বলে ওঠে সবাই—ন্যাকামি ছুটায়ে দেব কুত্তার বাচ্চা। যে ফুটা দিয়ে আসছোস এক্কেবারে সেই ফুটার মধ্যে ঢুকাইয়া দেব। বল, তুই কী দেখছোস?
আমি শুধু মোবাইলটা পড়তে দেখেছিলাম—লোকটি ধীরস্থিরভাবে উত্তর দেয়।

লোকগুলো অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। চীৎকারে ফেটে পড়ে—শুয়োরের বাচ্চা, তুই আর কিছু দেখস নাই? তুই মোবাইল পড়তে দেখছোস, আর কিছু দেখোস নাই। তার মানে কী?
তোর চোখ কী মোবাইল ছাড়া আর কিছু দেখে না?
দেখে—লোকটি উত্তর দেয়।
তাইলে তুই দেখোস নাই কেন?
দেখছি তো।
এই তো লাইনে আসছোস। বল, কী দেখছিস। লক্ষ্মী ছেলে, খালি খালি বকছি। বলো বাবা কী দেখছো?
মোবাইলটা পড়তে দেখেছিলাম।
ওরে হারামজাদা, বাইনচোত, সেটা তো আগেই বলছিস। এই প্যাঁচাল আর কত? এছাড়া আর কী দেখছোস, ঠিক কইরা ক। এছাড়া আর কিছুই দেখোস নাই? তাইলে ওই ছেলেটা কই গেলো? ছেলেটার হদিস মেলে না ক্যা?
মেয়েটার হদিস মেলে কি—লোকটা জানতে চায়।
মেয়েটার হদিস মিলব না ক্যা? মেয়েটা তো বহাল তবিয়তেই আছে। লোকগুলো উত্তর দেয়।
তাই?
হ, তাই। কিন্তু তারপর থেকে ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কই গেছে, মরেছে না বেঁচে আছে, তার কোনো হদিস নাই।
দেখেন চেষ্টা করে, যদি পান তাহলে তো ভালোই হয়।
ভালো তো হবেই। এমন প্যাঁদানি দেব এখনই জানা যাবে সব।

লোকগুলোর প্রত্যেকেই লোকটি ইচ্ছেমতো পিটুনি দেয়। এবং এই তালিকায় সবার শেষে থাকা লোকটা যেন একটু বেশিই বাহাদুর। সে শুধু পিটুনি দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, গজরাতেও থাকে পিটুনির সঙ্গে সঙ্গে।
বল, কুত্তার বাচ্চা, কী দেখছোস?
শুধু মোবাইলটা পড়তে দেখেছিলাম। লোকটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়।

লোকগুলোর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে তারা। পত্রিকা-টেলিভিশনের যন্ত্রণায় আমরা জ্বলে মরছি। আর কুত্তার বাচ্চা সারাক্ষণ একই প্যাঁচাল পাড়ছে, ‘আমি শুধু মোবাইলটা পড়তে দেখেছিলাম।’ পত্রিকায় হেডিং করেছে, ‘ধানমন্ডি লেকে মোবাইল পড়ার ১২ ঘণ্টা পরও মোবাইল মালিকের হদিস মেলেনি।’ লোকগুলোর মধ্যে একজন লোক, লোকটার কাছাকাছি হাজির হয়। তারপর গায়ের সবটুকু বল দিয়ে পাছায় একটা কষে লাথি দেয়।

লোকটি কিছু বুঝে উঠার আগেই, সামনের দেয়ালে সজোরে ধাক্কা খায়। ব্যথায় কুঁকিয়ে ওঠে। সেই অবস্থায়ই লোকগুলো আবারও বলে ওঠে:
হারামির পো তুই কী দেখছোস, আর কী শুনছোস?
আমি শুধু মোবাইলটা পড়তে দেখেছিলাম। লোকটি যথারীতি আবারও একই কথা বলে।

এটা তো বুঝলাম রে চুত মারানির পো। শুনছিস কী বল?
মোবাইলটা পড়ে যেতে দেখলাম, এবং তারপর শুনলাম—লোকটি বলে।

কী শুনলি? সবাই জানতে চায়।

শুনলাম, মেয়েটি ছেলেটাকে বলছে, তুমি মোবাইল ফোনটাই ধরে রাখতে পারো না, তাহলে আমাকে কিভাবে সারাজীবন ধরে রাখবা? তোমার তো ওই লেকের পানিতে ডুবে মরা উচিত। তোমার মতো অপদার্থকে আমি আর কখনো দেখতে চাই না। এটুকু বলে লোকটা একটু দম নেয়।

তারপর, তারপর, তারপর? লোকগুলো জানতে চায়।

ছেলেটা, মেয়েটাকে বলে আমার চেয়ে তোমার কাছে মোবাইলটাই বড় হয়ে গেলো?
মোবাইল বড় হবে না তো, তুমি বড় হবা না কি?

মোবাইল গেছে, তুমিও যাও আমার জীবন থেকে। চিরতরে দূর হয়ে যাও। লেকের জলে ডুইবা মরো। তারপর লোকটা চুপ করে থাকে। এবং পরক্ষণেই চিৎকার করে বলে ওঠে, দোহায় আপনাদের আমার কাছে কিছু জানতে চাইবেন না। আমি কিছু জানি না। আমি কিছু শুনিনি। আমি শুধু মোবাইলটা পড়তে দেখেছি!