দাসপ্রথা: শেষ হয়েও হইল না শেষ

 রেজাউল করিম খান/

দাপ্তরিক আইনে পৃথিবী থেকে দাসপ্রথা শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবে অনেক দেশেই মানুষ এখন নব্যদাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। সেই বিষয়ে পরে আসছি। আজ দেখি অতীতে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, আন্দোলন ও আইনের প্রয়োগ কিভাবে হয়েছিল। ১৭৭০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের থেকে আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের একেবারে প্রারম্ভে প্রথমবারের মতো আমেরিকায় একটি হত্যাকান্ড হয়। এ সময়ে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি ব্রিটিশদের গুলিতে মারা যান, তিনি ছিলেন একজন দাস। তার নাম ক্রিসপাস এটাক্স। বলা হয়, আমেরিকার স্বাধীনতার অঙ্কুরোদগম ঘটেছিল তার নিহত হবার মধ্য দিয়েই। এছাড়া আমেরিকান রেভল্যুশন, বা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রায় ৫,০০০ কৃষ্ণাঙ্গ দাস ও নাবিক তাদের হয়ে যুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধ শেষে তাদের অনেককেই মুক্ত করে দেওয়া হয়, তারা ফিরে যায় স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু ১৭৮৮ সালে আমেরিকার নতুন সংবিধানের মাধ্যমে দাসপ্রথাকে আইনসম্মত করে দেওয়া হয়। ফলে নতুন উদ্যমে দাসব্যবসা শুরু হয়ে যায়।
দক্ষিণ আমেরিকায় দাসদের এই করুণ দশা উত্তর আমেরিকার মানুষের মনে একটি অসন্তোষ দানা বাঁধার সুযোগ করে দেয়। এই অসন্তোষ অচিরেই আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনটি ছিল মনুষ্যত্বের পক্ষের শক্তির আন্দোলন, কারো কোনো ব্যক্তিস্বার্থ এতে ছিল না। ধীরে ধীরে এটি জোরদার আন্দোলনে পরিণত হয়। ইতিহাস এই প্রতিবাদের একটি নাম দিয়েছে, তা হলো ‘অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্ট’। ১৮৩০-৬০ সালের মাঝে আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। ফ্রেডেরিক ডগলাসের মতো প্রাক্তন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এছাড়া ‘দ্য লিবারেটর’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন একজন শ্বেতাঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আন্দোলনে সমর্থন জানান। ঠিক এরকম সময়েই হ্যারিয়েট বিচার স্টো তার কালজয়ী দাসপ্রথাবিরোধী উপন্যাস ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ প্রকাশ করেন।
‘টুয়েলভ ইয়ার্স অ্যা স্লেইভ’ চলচ্চিত্রটি একই শিরোনামের একটি বইয়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে, যে বইটির লেখককের নাম সলোমন নর্থাপ। ১৮০৭ সালে নিউইয়র্কে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ এই আমেরিকান কৃষক নিজের জীবন নিয়ে রচনা করেন এই বইটি । তিনি মুক্ত মানুষ হওয়া সত্বেও তাকে দাস বানানো হয়। ১৮৫৩ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে দাসত্ব থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পান সলোমন।
একই বছরে স্থানীয় লেখক ডেভিড উইলসনের সাথে মিলে তিনি নিজের জীবনের গল্প অবলম্বনে লেখেন ‘টুয়েলভ ইয়ার্স অ্যা স্লেইভ’। ৩ বছরের মধ্যে বইটির ৩০,০০০ কপি বিক্রি হয়। ততদিনে নর্থাপ জাতীয় নায়কে পরিণত হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কথা বলতেন, বাড়াতেন লোকের সচেতনতা।
১৮৬২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে আব্রাহাম লিংকন দাসদের স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রাথমিক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। অবশেষে ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে তিনি দাসত্বমোচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে এই কুপ্রথার পাকাপাকিভাবে বিলুপ্তি ঘটান। ৩ মিলিয়নের বেশি কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে এই ঘোষণা সার্থকতা লাভ করে। তবে এটা ঠিক যে প্রজ্ঞাপন জারির পর রাতারাতি দাসপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়নি, আরও কিছুদিন যাবৎ ক্রীতদাস বেচাকেনা চলেছিল। তবে অচিরেই আইনানুগ ব্যবস্থা প্রয়োগ করে এটি নিষিদ্ধ করা হয়।
স্পার্টাকাস, ইতিহাসের অনন্য নায়ক। প্রাচীন রোমের এই দাস বিদ্রোহী সম্পর্কে ফরাসি চিন্তাবিদ ভলতেয়ার বলেছেন ‘তার যুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ— হয়তো ইতিহাসের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ।’ ইতিহাসে তার প্রিয় চরিত্র কে? কন্যার এই প্রশ্নের জবাবে মহামতি কার্ল মার্কস উত্তর দিয়েছিলেন ‘স্পার্টাকাস’। স্পার্টাকাস ছিলেন একজন গ্লাডিয়েটর। গ্লাডিয়েটরদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন স্পার্টাকাস। স্পার্টাকাসকে নিয়ে অসাধারণ একটি উপন্যাস লিখেছেন মার্কিন লেখক হাওয়ার্ড ফার্স্ট। স্পার্টাকাসকে নিয়ে হলিউডে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। আধুনিককালে দাসপ্রথাবিরোধী বিদ্রোহের তাৎপর্যময় দৃষ্টান্ত হাইতির দাস বিদ্রোহ। হাইতির দাস বিদ্রোহ (১৭৯১-১৮০৩) পৃথিবীব্যাপী দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছিল। ইতিহাসবিদ সিএলআর জেমস হাইতির দাস বিদ্রোহ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইতিহাসের একমাত্র সফল দাস বিদ্রোহ।’ হাইতির দাস বিদ্রোহ ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। হাইতি বিপ্লবের প্রভাব পড়ে ব্রিটেনেও। ১৮০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের আটলান্টিক জোড়া দাস ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। আর ব্রিটেনে দাস ব্যবস্থার অবসান ঘটে ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে। ফ্রান্সে দাস প্রথার বিলোপ হয় ১৮৪৮ সালে।
আমেরিকার দক্ষিণাংশের ১১টি রাজ্যের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল দাসশ্রম। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ মিলিয়ন। আমেরিকার উত্তরাংশে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে সমাজ সংস্কারক উইলিয়াম গ্যারিসন, ‘আংকল টমস কেবিন’ এর লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো প্রমুখের নেতৃত্বে। ১৮৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আব্রাহাম লিংকন। লিংকন আমেরিকার পশ্চিমাংশে দাসপ্রথা প্রসারের বিরোধিতা করেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল শুরু হয় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিংকন ‘দাসপ্রথাবিরোধী ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণাংশের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর দাসদের দাসত্ব মোচন করেন। ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়।
প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে সমাজে মানুষ কেনাবেচার একটি প্রথা ছিল, যা দ্বারা বিভিন্ন মূল্যের বিনিময়ে মানুষ কেনা যেত। এই প্রচলিত প্রথাটিকেই দাসপ্রথা বলা হয়ে থাকে। দাস অথবা দাসী বর্তমান বাজারের পণ্যের মতোই বিক্রি হতো। বর্তমানে যেমন পণ্য বেচাকেনার বাজার আছে, অতীতেও দাসদাসী বিক্রি অথবা কেনার আলাদা বাজার ছিল। সভ্যতা বিকাশের ধারায় মানব সমাজে উদ্ভব ঘটে দাসপ্রথার। কালের টানে এক সময় বিলোপও হয়ে যায়। কিন্তু সভ্যতার গায়ে ক্ষতচিহ্নের মতো রয়ে গেছে এই অমানবিক প্রথার দাগ। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট বৈশ্বিক তারিখ নেই। একেক দেশে একেক দিন দাসপ্রথাকে বিলোপ করা হয়। প্রাচীন দক্ষিণ এশীয় পি ত কৌটিল্য দাসপ্রথা তুলে দিতে তার সম্রাটকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সম্ভবত এটাই দাসপ্রথা বিলোপের প্রথম উদ্যোগ। আর সর্বশেষ দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৯৬৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী ২ ডিসেম্বরকে পালন করা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য অ্যাবলিউশন অব স্লেভারি’ হিসেবে। এদিন মূলত স্মরণ করা হয় সভ্যতা বিকাশে দাসদের অবদানের কথা; স্মরণ করা হয় গ্লানিময় এক প্রথার কথা।
পৃথিবীর কয়েকটি দেশে দাসপ্রথা বিলোপের সময়কাল ঃ সুইডেন ১৮৪৬, আর্জেন্টিনা ১৮৫৩, মেক্সিকো ১৮২৯, ডেনমার্ক ১৮৪৮, কিউবা ১৮৮৬, ব্রাজিল ১৮৮৮, মাদাগাস্কার ১৮৯৬, চীন ১৯১০, আফগানিস্তান ১৯২৩, ইরাক ১৯২৪, ইরান ১৯২৮, মিয়ানমার ১৯২৯, সৌদি আরব ১৯৬২, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৯৬৩, নেপাল ১৯২৬।