তিস্তার পানি কমলেও বেড়েছে নদীভাঙ্গন আতঙ্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক: তিস্তার পানি কমে গেলেও তিস্তা চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন আতঙ্ক।

ভারি বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে লালমনিরহাটে ৫ দিনব্যাপী সৃষ্ট বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে।

দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বর্তমানে পানি প্রবাহ কমে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

তবে বন্যার পানি কমলেও সেখানে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। ইতিমধ্যে গত দুই দিনে জেলার কয়েক শতাধিক বসতবাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে।

বর্তমানে ভাঙ্গন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তা পাড়ের মানুষের।

মঙ্গলবার (৩০ জুন) সকালে গোকুন্ডা ইউনিয়নের চর গোকুন্ডায় গেলে দেখা যায় ভাঙ্গন কবলিত লোকজনের আহাজারি। সেখানে যাওয়া মাত্রই ভাঙ্গন কবলিত লোকজন দৌড়ে এসে তাদেরকে সাহায্যের সাহায্যের আকুতি জানায়।

জানা গেছে, ধরলার আর তিস্তা নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটের দুই পাশেই দুই নদী প্রবাহিত। জেলার ৫টি উপজেলাকে ঘিরে রেখেছে এই খরস্রোত দুই নদী।

বালু জমে তলদেশ ভরাট হওয়ায় শুস্কমৌসুমে পানির অভাবে ধু ধু বালু চর হলেও বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহের পথ না থাকায় বন্যা আর ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারন করে তিস্তায়।

প্রতিবছর তিস্তার কড়াল গ্রাসে বসতভিটা হারিয়ে বাঁধ আর রাস্তার ধারে মানবেতর জীবন যাপন করে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর লোকজন।

ভাঙনে ফসলি জমি বিলিন হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে নদী খনন করে উভয় তীরে বাঁধ নির্মাণ করে স্থায়ী সমাধান দাবি করছে তিস্তার বাম তীরের মানুষ। প্রতি বছর ভাঙনের সময় আশ্বস্থ করা হলেও কার্যত দীর্ঘ দিনের এ দাবি পুরন হয়নি তিস্তাপাড়ের মানুষের।

নদীর অনবরত ভাঙ্গনের শিকার হওয়া পরিবারের লোকজনের মধ্যে চলছে শুধু কান্না আর কান্না। প্রিয় বসতভিটাটিও শেষ পর্যন্ত নদী গর্ভে চলে যাওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে অনেকে হয়েছেন বাকরুদ্ধ।

একের পর এক নদীভাঙ্গনের কারনে তিস্তা পাড়ের মানুষজন সর্বশান্ত হয়ে গেছে।

বর্তমানে এসব খেটে খাওয়া মানুষ গুলো একদিকে করোনার কারনে যেমন কর্মহীন হয়ে পড়েছে অপরদিকে শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গন। ফলে অনাহারে ,অর্ধাহারে তাদের জীবন কাটছে।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) মধ্যরাত থেকে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ১৮ থেকে ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তিস্তার বাম তীরে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার টানা ৫দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

তবে সোমবার (২৯ জুন) সকাল থেকে কমতে শুরু করে তিস্তার পানি প্রবাহ। ফলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি ঘটে। পানি নামতে শুরু করলে কয়েকদিনের পানিবন্দি থেকে মুক্তি পায় বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন। তবে পানি কমলেও দুর্ভোগ বেড়েছে বন্যাকবলিতদের মধ্যে।

টানা পাঁচ দিনের বন্যায় ডুবে থাকায় নষ্ট হয়েছে ঘরবাড়ি ও রাস্তা-ঘাট। নষ্ট হয়েছে আমন বীজতলা, বাদাম ও ভুট্টাসহ নানান জাতের সবজি। বন্যায় নষ্ট হওয়া ঘরবাড়ি মেরামত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।

এদিকে তিস্তার পানি কমে গেলেও চরাঞ্চলের লোকজনের মাঝে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন আতঙ্ক ।

সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, আদিতমারীর কুটিরপাড়, চন্ডিমারী, দক্ষিণ বালাপাড়া, কালীগঞ্জের শৈলমারী চর, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, সিন্দুর্না, ডাউয়াবাড়ি ও গড্ডিমারীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।

গত দুই দিনে জেলার শতাধিক বসতবাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে কয়েকশ ঘরবাড়ি, স্থাপনা ও ফসলি জমি। ভাঙ্গন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তা পাড়ের মানুষের।

সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা গ্রামের ভাঙনের কবলে পড়া বাদল মিয়া, শরীফ ও রহমত উল্লাহ বলেন, গত ১০ দিনের ব্যবধানে আমাদেরসহ এ গ্রামের ২৫টি বসতভিটা, কবরস্থান, ফসলি জমিসহ বিস্তৃীর্ন এলাকা তিস্তারগর্ভে বিলিন হয়েছে।

কেউ পাশে জমি ভাড়া নিয়ে মাথাগুজার ঠাঁই পেলেও অনেকেই রাস্তার ধারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় পরিদর্শন করে বাঁধ নির্মানের আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন নিয়ে শ্বঙ্কা।

করোনা ভাইরাস সংক্রামন রোধে বাহিরে বের হতে না পেয়ে অনেকেই অর্থ কষ্টে ভুগছেন। এর মাঝে নদী ভাঙন শুরু হওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে বলেও দাবি করেন তারা।

পানিবন্দি ও নদী ভানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। পানিবন্দি প্রতি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল, আলু এবং নদী ভাঙ্গনের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য জনপ্রতি ২০ কেজি চাল ও ৭ হাজার টাকা বিতরণ করা হচ্ছে।

হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজানের আতিয়ার রহমান ও মোহাব্বদ আলী বলেন, তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত রোববার রাতে তাদের বসতভিটা তিস্তা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়দের সহায়তায় ঘরের টিন খুলে নিয়ে রাস্তায় রেখেছেন। নতুন করে বাড়ির করার মত জায়গা না থাকায় তারা রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তিস্তার তীরে বন্যা ও ভাঙ্গনের হাত থেকে বাঁচতে তিস্তা খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে সরকারের দাবী জানিয়েছেন তিস্তা পাড়ের বানভাসি মানুষ।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউিপ চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা স্বপন জানান, নদীর পানি কমলেও গত দুইদিন থেকে ভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন তিস্তা পাড়ের লোকজন। নদীভাঙ্গনের কারনে তিস্তা পাড়ের মানুষজন সর্বশান্ত হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে সরকারের এসব খেটে খাওয়া মানুষের পাশে এসে দাড়ানো উচিত বলে জানান তিনি।

লালমনিরহাট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী হায়দার বলেন, পানিবন্দি ৮ হাজার পরিবারের জন্য ৬৮.৬৬ মেট্রিকটন জিআর চাল এবং ৬ লাখ ২৬ হাজার ২শ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা ইতোমধ্যে বিতরণ শুরু করা হয়েছে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৪১ পরিবারকে জনপ্রতি ২০ কেজি চাল ও ঘর মেরামত বাবদ নগদ ৭ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হচ্ছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, করোনার মাঝেও আসন্ন বন্যা আর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত রয়েছে সরকারী কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় ত্রান বিতরন শুরু হয়েছে। নদী ভাঙ্গন রোধে দ্রুুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।