বিষ্ময়ে সমুদ্রদর্শন

কাওছার আলম/
নোনা জলে ধুয়ে যায় নোনা জল
ক. বিবর্ণ দিনগুলোকে পেছনে ফেলে সমুদ্র দেখতে চলেছি; কি অবাক করা ব্যাপার! অর্থের টানাটানি আর পড়াশুনার চাপ সব কিছু সাথে নিয়েই অগ্রসর হওয়া। গুরুর সমুদ্রের প্রতি যে, একটা টান আছে তা জানতাম। ইচ্ছে ছিল গুরুর সাথে সমুদ্রের তীরবর্তী হওয়া। তা হয়নি। ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁয় রইল না’ বলে। রবিবার সন্ধার আড্ডার দিনগুলোতে সমুদ্রতো স্বপ্নলোকের দিব্যরথ হয়ে উঠেছিল। চিত্রময়, মিস্টিকÑএকটা অদৃশ্য অথচ দৃশ্যমান রুপে ধরা দিত। জীবনে স্বপ্নের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল সমুদ্র; সমুদ্রবর্তী মানুষ আর বাকীসব । গাদা গাদা বই এর বর্ণনা, ডিস্কভারী চ্যানেল এর রিপোর্ট, সিনেমা নামের বিনোদন উৎসে অর্ধ-নগ্ন রমণীদের সাথে সমুদ্রের কিয়দংশ দেখা যায় বৈকি! তাতে মন ভরে না। বরং একটা অতৃপ্তি, অজানা বিষয়ের প্রতি টান আরো বাড়ে। উজানের মানুষ আমরা, উত্তরবঙ্গের লালমাটি, সূর্যের প্রখরতা আর বৃষ্টির স্বল্পতা হেতু রুক্ষতা আমাদের ত্বকে-মনটাও হয়ত বিবর্ণ। নদী আর বিলের মিঠা পানির সাথে জানাশোনা থাকলেও সমুদ্রের বিশালতা আর লবনাক্ত জলের সাথে কোন সাক্ষৎ ছিল না।
মার্ক টোয়েন এর ‘এ্যাডভাঞ্চার অব হাকল্বেরি ফিন’ কিংবা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দা সি এর অনুবাদ পড়তে পড়তে সমুদ্রের প্রতি একটা টান- একটা মমতা সাহসই গড়ে উঠেছিল। কত অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে সমুদ্র্রের কাছে মানুষ যায়-সবকিছু ভুলে শুধু প্রাপ্তির নিকাশ নিয়েই ঘরে ফেরে। হেমিংওয়ে অবশ্য আতœহত্যা করেছিলেন-টুটু বোরের পিস্তল তাকে মৃত্যুর স্বাদ দিয়েছিল। কিন্তু সমুদ্রের প্রতি যার এতো প্রবল ভালোবাসা তাকে বিষণœতা কিভাবে গ্রাস করেছিল? ভাবতাম খুব । অবশ্যি হেমিংওয়ের মুত্যু অনেকটা জিনগত ব্যাপারও বটে। তাঁর পরিবারে আরো অনেকেই আতœহত্যা করেছিলেন। যা- হোক, ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি তো জীবিত। জীবিত সেই বৃদ্ধ। তেমনি এস.টি কলরিজ এর এনস্যাইন্ট মেরিনারর সেই বৃদ্ধ নাবিক যে কিনা ‘এ্যালবাট্রস’ পাখি হত্যার দায়ে আত্মদ্ব›েদ্ব ভুগছিল, সমুদ্রের বুকে জল ছাড়া বেঁচেছিলো দীর্ঘদিন। বৃদ্ধ বলছিলÑ ধিঃবৎ,ধিঃবৎ বাবৎুযিবৎব হড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ’ এই হতাশাÑএই কষ্ট তখন ছড়িয়ে গিয়েছিল আমার মোন। এভাবে ধীরে ধীরে সমুদ্রের প্রতি মমতা জড়ানো ভালোবাসার তৈরি হয়েছিল এক সময়।
খ. দীর্ঘ ভ্রমণের পর আমরা যখন সমুদ্রতীরে তখন রাত প্রায় দ্বি-প্রহর। দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু শো শো আওয়াজ আসছে। ঠিক তারপরই ঢেউগুলো এলো ; একের পর এক। বিপুল উচ্ছাসে ঢেউগুলো এসে পায়ের তালে নতজানু হয়ে ফিরে যাচ্ছে। বালি সরে যাচ্ছে পায়ের তলা থেকে। জ্যোৎ¯œালোকিত রাত; কুয়াশা নেই একটুও। শীতল বাতাস আর মুক্ত সতেজ আবহাওয়া। ‘বিবর্ণ প্রাণ’ সমুদ্রেতীরে তাই যেন সতেজ হয়ে উঠতে চায়। বোধ হয় আকাশের তারার ঝিকমিক করছে সমুদ্র জলে। জ্যোৎ¯œা রাত, সামনে উন্মুক্ত-উত্তাল সমুদ্র মোহনীয় দৃশ্যের অবতারনাই করেছিল। সমুদ্রের তীর ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়,স্থবির। একদিকে প্রাণের চঞ্চল-উচ্ছল বেগ অন্যদিকে স্থবিরতা, শান্ত-মৌন-গম্ভীর। সমুদ্র দেখার আগে শুভ্র শঙ্খে কানপেতে শুনেছি সমুদ্রের গর্জনÑ ‘শো শো আওয়াজ। যেন বিশ্ব ব্রাহ্মন্ড বোঙ্গে চুরে তছনছ করতে চায়।পৃথিবীর প্রতি তার যেন বিপুল আক্রোশ। কবিগুরু ‘ছিন্নপত্র’- এ লিখেছিলেন : ‘… অসহায় অনাবৃত সমুদ্র ফুলে ফুলে ফেনিয়ে ফেনিয়ে সাদা হয়ে উঠেছে। সমুদ্রকে আমার মনে হয় কী একটা প্রকান্ড অন্ধ শক্তি বাধা প’ড়ে অস্ফালন করছে-আমার। নিশ্চিন্ত মনে তীরে দাঁড়িয়ে আছিÑসমুদ্রের বিস্ফারিত গ্রাসের মুখেই আমরা ঘর বাড়ি বেঁধে বসে আছি! আমরা যেন সিংহের কেশর ধরে টানছি, অথচ সিংহ কিছুই বলতে পারছে না-একবার যদি সমুদ্র ছাড়া পায় তাহলে আমাদের আর চিহ্ন মাত্র থাকে না। খাঁচার মধ্যে বাঘ তার লেজ আছড়াচ্ছে, আমরা কেবল দুু’ হাত তফাতে দাঁড়িয়ে হাসছি। একবার চেয়ে দেখুন কী বিপুল বল। তরঙ্গগুলো যেন দৈত্যের মাংসপেশীর মতো ফুলে উঠছে। পৃথিবীর সৃষ্টির আরাম্ভ থেকে এই ডাঙ্গায় জলে লড়াই চলছেÑ ডাঙ্গা ধীরে ধীরে নীরবে এক-একপা ক’রে আপনার অধিকার বিস্তার করছে, আপনার সন্তানদের ক্রমেই কোল বাড়িয়ে দিচ্ছে-আর পরাজিত সমুদ্র পিছু হটে হটে ফুঁসে ফুঁসে বক্ষে করাঘাত করে মরছে। মনে রাখবেন এককালে সমুদ্রের একাধিপত্য ছিলÑতখন সে সম্পূর্ণ মুক্ত। তুমি তারই গর্ভ থেকে উঠে তার সিংহাসন কেড়ে নিয়েছ, উন্মাদ বৃদ্ধ সমুদ্র তার শুভ্র ফেনা নিয়ে শরহম খবধৎ এর মত ঝড়ে ঝঞ্ঝায় অনাবৃত আকাশে কেবল বিলাপ করছে।’
আমার বার বার সে কথাই মনে হয়েছে বিস্তীর্ণ বালু রাশি ধরে হেঁটে হেঁটে অস্থায়ী ডেরায় ফিরে এসেছিলাম সেদিন ।
গ. এক একটা ডেউ আসছে- বালিয়াড়িতে আঘাত করছে, ফিরে যাচ্ছে, আবার আসছে, আবার যাচ্ছে, এভাবে চলছেই ক্রমাগত। সমুদ্রপাড়ের মানুষের জীবনের যে দার্শনিক ভিত্তি তাও হয়ত এভাবেই অগ্রসরমান। একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে, প্রতিকূলতা কাটিয়ে বড় হচ্ছে, এক সময় পৃথিবীর কর্ণধার হচ্ছে আবার মৃত্যুবরণ করছে। এই ইস্পাতসম কঠিন জীবনের দ্বায়ভার মানুষ অনায়াসে বহন করছে, কষ্টের মাঝে থেকেও জীবনকে ভালবাসছে। জীবন যে আসলে সুন্দর এবং উপভোগ্য সমুদ্রতীরে দাঁড়ালেই কেবল বোঝা যায়। জীবনে না পাওয়ার যাতনা, অতৃপ্তি, ‘সকল দুঃখের প্রদীপ’ পেছনে ফেলে সমুদ্রের এই বিশালত্বের কাছে নিজের আত্মিক সর্মপণ- সত্যিকার অর্থেই নিজেকে স্বয়ম্ভু করে তোলে-বাঁচতে শেখায়।
ঘ. জলের সাথে নীলের যে এত সখ্য তা সমুদ্র না দেখলে বোঝা যায় না। আকাশে সাদা সাদা পেজা তুলোর মত মেঘ ভেসে যাচ্ছে। দূরে গভীর নীল জল। তীর গম্ভীর অথচ খল খল ধ্বনির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। শব্দে কানপাতা দায়। জীবনের সকল দুঃখের যবনিকাপাত করতেই যেন সমুদ্রর এই ডাক। কত শত ছোট বড় নৌকা- ট্রলার মাছ ধরার জন্য বিশাল সমুদ্রের বুকে জাল বিছাচ্ছে-ঢেউ এর সাথে পাল্লা দিচ্ছে। ঢেউ এর বুকে চেপে গভীর জল থেকে উঠে আুসছে তীরে-নৌকার খোল ভরে মাছ নিয়ে। সমুদ্র জীবন সংগ্রাম শেখাচ্ছে, বাঁচতে শেখাচ্ছে, শেখাচ্ছে কিভাবে টিকে থাকতে হয়। রোদে পোড়া-বৃষ্টি আর নোনা জলে ভেজা পেশীবহুল মানুষগুলো উদয়াস্ত সমুদ্রের সাথে লড়াই করেই তো বেঁচে আছে। দাসানুদাস হয়ে আছে জলের। ভয়ে হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া সব বড় ঢেউ দেখেও তারা সামনে যাচ্ছে। ভাবছে এবার দেখাই যাক না কি হয়! জীবনকে বাজির ঘোড়া বানিয়ে নীল জলের সাথে গড়ে তুলছে সখ্য। মাছ ধরার নৌকা, জাল এমনকি মাঝে মাঝে স্বজনও হারিয়ে যাচ্ছে নীল জলের গভীর প্রলোভনে, তারপরও কী জল ছেড়ে উঠে আসা যায়? বংশপরম্পরায় আনন্দ-বেদনায় যুক্ত এই জলের সাথেই যে কিছু মানুষের নিত্যকার সম্বন্ধ। ফিসারী ঘাটগুলো যেন এই সব পরিশ্রমী আর দিলদরিয়া মানুষগুলোর সদাচঞ্চল পদক্ষেপে জেগে থাকে সর্বক্ষণ।
ঙ. ডেরা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়। সূর্যোদয় দেখার জন্য তাই আমরা পুব আকাশ আলোকিত হবার অগেই ডেরার সামনে। সমুদ্রের জল থেকে যেন সূর্যদেব উঠে আসছে-আলোক প্রভা ছড়াতে ছড়াতে। সেই মূহুর্তটা ক্ষণস্থায়ী। এরপর জোয়ার ভাটার খেলা চলতে থাকা সমুদ্রের তীর ধরে এগিয়ে যেতে যেতে মৌসুমি ভৌমিকের একটি গানের কথাগুলো মনে পড়ছিল :
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউ-এ চেপে নীল জল ছুঁয়ে এসেছে,
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
নোনা বালি তীর ধরে বহুদুর হেঁটে এসেছ
আমি কখনো যায়নি জলে কখনো ভাসিনি নীলে
কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাঙচিলে…

আমার একপাশে উদ্ভিন্ন রমণী, অন্যপাশে উত্তাল সমুদ্র। আমার কাছে দুই-ই সত্য। ‘ সোনামুখী ’র রুপের ছটা আর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ মনের ভোগলিক অবস্থা আমূল পাল্টে দিয়েছিল। উষ্ণরক্তের প্রলোভনে মানুষ হিং¯্র হয়ে উঠে। মেতে উঠে ধ্বংসযজ্ঞে। আমি শুধু সৌন্দর্যটুকু দেখেছি। মেঘমেদুর আকাশ আর গভীর জল আমাকে সৌন্দর্যের পূজারীহ’ করে তুলেছিল। বড় বড় ঢেউ কেটে কেয়ারী সিন্দাবাদ যাচ্ছে সেন্টমার্টিন। প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন নারকেলের জন্য বিখ্যাত। সুস্বাদু আর আকারে বড় এই দ্বীপের নারকেল। যাহোক ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে জাহাজের গায়ে। ফেনায়িত হয়ে যাচ্ছে। একটু দূরেই ডলফিন ভুস করে উঠে লুকিয়ে যাচ্ছে জলে। সমুদ্রে গভীর নীল জলে হাঁস দলবেধে ভেসে আছে, সংখ্যায় তারা অসংখ্য। বিস্ময়ে বিস্ফরিত চোখে শুধু তাকিয়ে থাকা। চর্মচক্ষু শুধু সমুদ্রই দেখছে না, দেখছে তীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা স্থির পাহাড়, পাহাড়ের আকাশচুম্বী বৃক্ষ আর তাদের ঘিরে বেঁচে থাকা প্রাণীকুল। সমুদ্রের অরেক বিষ্ময় পাহাড় বেষ্ঠিত দ্বীপ। সমুদ্রের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। কি বিচিত্র, মোহনীয় আর বিস্বয়কর এর রুপ। চারপাশে নীল জলরাশি,পাহাড়, কিছু লোকালয় আর মন্দির । মানুষ বেঁচে আছে পূর্ণ উদ্যমে। আমার সোনামুখীর হাতের বাঁধন হয়ত শিথিল হয়েছে কিন্তু সৌন্দর্য হারায়নি একটুও। আমরা ফিরে এসেছি অস্থায়ী ডেরায় ভালো লাগা সংগে নিয়ে।
চ. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের ময়না দ্বীপের শ্বাপদ- এ পূর্ণ ভয়ঙ্কর কষ্টকর জীবন আর হরিশংকর জলদাস’র মৎস্য শিকারীদের দুর্বিহ জীবনকে পড়েছি, ভেবেছি সমুদ্র না থাকলে হয়ত এতটা সাহস তারা পেত না। জীবনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সমুদ্র তাদের অনেক বেশি এগিয়ে রাখে। সমুদ্র তার বিশ্বালত্ব দিয়ে জীবনের সব ক্ষুদ্রতা –দৈন্যতা-অসহায়ত্ব ঢেকে’ দিতে চায়। জয়ের প্রেরণা মানুষ এখান থেকেই পেয়ে যায়।
ছ. সমুদ্র পাড়ের সূর্যাস্ত দেখা হয়নি । লাল নীলিমায় সমুদ্র কেমন দেখায় সূর্যকেই বা কেমন লাগে দেখা হয়নি। গুরুর সাথে সেই সৌন্দর্যের নির্যাসটুকু পান করব নিভৃতের এ চাওয়া পূর্ণ না হলেও সুনামির জল বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ত প্লাবিত করবে, মানুষ্য জীবন বিপন্ন হবে; তারপরও মানুষ টিকে থাকবে। সমুদ্রের সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতেই হয়তো।