আমাদের দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে বছর ভর্তি তারিখ সাজানো থাকে। সব তারিখ মনে রাখার মত নয়। কাজেও লাগে না। কিছু কিছু তারিখ মনে রাখতে হয়। নানা জনে নানা কারণে মনে রাখে। যারা ধর্মাচার,উপাসনা ইত্যাদি মানেন তারা ধর্মানুষ্ঠানের তারিখ গুলো মনে রাখেন। যারা সংস্কৃতির বৃহত্তর আঙ্গিনার দিকে চোখ রাখেন তাদের আরো অনেক তারিখ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।এর মধ্যে একটি তারিখ আমাদের বাংলা ভাষার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।
বাঙালির অস্তিত্ব মানে বাংলা ভাষা বলতে বলতে বেঁচে থাকা। মনে রাখবেন নিজের ভাষা বলছি আর বেঁচে আছি এই ঘটনাটা পৃথিবীতে নানা সংকটের মুখে পড়েছে।একসময় ছিল সাম্রাজ্যবাদ। ইউরোপিয়ানরা উপনিবেশ তৈরি করেছে, স্বয়ং আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, আফ্রিকায় এমনকি আমাদের দেশেও, অনেক মানুষের ভাষাকে ধ্বংস করে তাদের মুখে নিজের ভাষা বসিয়েছে। ইংরেজি, স্প্যানিশ,ফরাসি, পর্তুগিজ। তারপরে এখন হয়েছে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ, তাও বিশ্বজুড়ে একটি ভাষার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার এমন ব্যবস্থা করেছে যে, অনেক ভাষায় তার কাছে হাতজোড় করে প্রাণ ভিক্ষা করার অবস্থায় রয়েছে। সংকট তৈরি হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে নানা সময়ে। শুধু প্রাণের আসংখ্য নয় মাতৃভাষার অপমান, তার ওপর অন্য ভাষার প্রভুত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বিনা কারণে। ভাষার বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ করেছে পথে নেমেছে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতেছে, বুকের রক্ত আর প্রাণ দিয়েছে। ইতিহাস তৈরি হয়েছে ১৯৫২ সালে। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা সৈনিকদের সেই আত্মদানের স্মৃতিটাই আমরা নতমস্তকে স্মরণ করি। এই হলো ইতিহাস।এই ইতিহাস আমরা বহন করছি গর্বের সাথে ,আমাদের এই গর্ব প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে ,প্রতিবছরই এই দিনটি আমরা স্মরণ করি শ্রদ্ধার সাথে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
কিন্তু প্রশ্ন করি কি, নিজেদের এই স্মরণ এই অনুষ্ঠানগুলো যথেষ্ট কিনা? আমরা সেই ভাষাকে কিরকম অবস্থায় রেখেছি তা কি কখনো ভাবি? বাংলা ভাষার অশুদ্ধ ব্যকরণগত প্রয়োগ, ভুল বানান,উচ্চারণ আমাদের অনেকেরই গা সহায় হয়ে গেছে। অনেকেরই ব্যকরণকে ব্যাকারণ বলা আমরা আত্মস্থ করে ফেলেছি। যদিও এই আকারের সমস্যা আজকের নয়। দুরবস্থা উচ্চারণে আকার বাহুল্য দেখে বিদ্যাসাগরের সরস মন্তব্যও আমরা জানি। তবে সেই দুরবস্থা বাড়তে বাড়তে এমন বিপুল আকার ধারণ করবে তা হয়তো স্বয়ং বিদ্যাসাগরও ভাবেননি। অবশ্য বানান উচ্চারণ নিয়ে অতিরিক্ত খুঁতখুঁতানিকে অনেকেই অতিউল্লাসিতা বলতে পারেন। কিন্তু শুধু বানান বা উচ্চারণ নয় সমস্যা আরো গভীর ও বহুমাত্রিক। যার অন্যতম হলো, অন্য ভাষার শব্দ এবং শব্দ বন্ধের অপ্রয়োজনীয় ও মিশ্রিত কিছু শব্দ হয়তো অনেকে ভাষার সহনশীলতা উদার মানসিকতা তুলবেন। বাংলা ভাষায় আবহমানকাল থেকে অজস্র অন্য ভাষার শব্দ এসেছে এবং তাদের সার্থক আত্তীকরণ ঘটেছে। বাংলা ভাষা গতিশীল সজীব ও উদার বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। এমনকি প্রতিটি বাঙালির জীবনে প্রথম শেখা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ গুলোর অন্যতম বাবা শব্দটি আদতে তুর্কি।
কিন্তু কোন ভাষাকে না বুঝে সেই ভাষা থেকে কিছু শব্দ তুলে এনে ভুল প্রয়োগে বকচ্ছপ ভাষা তৈরি করলে উদারতা নয় বরং ভাষাগত দৈন্যই প্রকট হয়। আরেকটি সমস্যা হল অন্য ভাষা থেকে অক্ষম আক্ষরিক অনুবাদ। এর অসাঢ়তা রবীন্দ্রনাথ তীব্র শ্লেষের সঙ্গে দেখিয়েছিলেন তাসের দেশে। এডিটোরিয়াল কলামকে সম্পাদকীয় স্তম্ভ লিখে। সম্প্রতি চোখে পড়ল একটি অনলাইন প্রতিবেদনে লিখা হয়েছে (বাধ্য হয়ে তিনি তোয়ালে ছুড়ে ফেললেন) আদতে সেটা বুঝা গেল (Throwing the towel) এই ইডিয়ম অর্থাৎ ইংরেজি বাগধারার বাংলা রূপান্তরের চেষ্টা যার অর্থ (পরাজয় স্বীকার করা) আর এই সব কিছুকে ছাপিয়ে যে বিষয়টা সবচেয়ে দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক তা হল, বাংলা ভাষা বলা আর লেখার প্রতি বাঙ্গালীদের অনীহা। একটা অবহেলা অনাদরে কুয়াশামাখা চাদর যেন বাংলা ভাষাকে ঢেকে ফেলছে। যা হওয়া উচিত ছিল গৌরবের ভাষা তার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে ব্লাক আর কুন্ঠা। এরপর বড় কারণ আজকে বাজার চালিত অর্থনীতিতে বাংলার চাইতে অন্য ভাষা কাজ দেয় বেশি। এই ভাবনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে সমৃদ্ধির ভাষা সাফল্যের ভাষা হিসাবেও অন্য ভাষাগুলোর কদর বাড়ছে।
বাংলা ধীরে ধীরে সরে আসছে আলোকিত সমাজ বৃত্তের পরিধির বাইরে। এই বিষয়টা নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন। ভাষা মানে তো কিছু শব্দ আর ব্যাকরণ গত খুঁটিনাটি নয়। ভাষা একটা জৈবিক বস্তু। এক সমগ্র জনগোষ্ঠীর মেরুদন্ড, তাদের জাতিসত্তা গঠন করে ভাষা। বরেণ্য ভাষাবিদরা বলেন কোনো ভাষা বেঁচে থাকবে কিনা– তা নির্ভর করে, মানুষ প্রাণানন্দে সেই ভাষায় কথা বলছে কিনা তার উপর। বাংলা ভাষায় সেই প্রাণের আনন্দ ফিরিয়ে আনতে হবে। ভাবার সময় এসেছে বাংলা ভাষায় যে স্নেহছায়ার মৃদুরতা, যে, মায়া পশমের উষ্ণ আলিঙ্গন আছে। তা কিভাবে অক্ষুন্ন রাখা যায়। তার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে। আজ আমাদের চারপাশে অহরহ যে বাংলা আমরা শুনি, সেই বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকোনে, উঠোনে একই রোদ ছড়ে? বারান্দায় লাগে কি? জ্যোৎস্নার চন্দন।
লেখক- কলিম উদ্দিন