জয়পুরহাটের ডায়েরি : গাছ পাথরের গল্প

কাওছার আলম/
কোনো উত্তাপ, কোনো শীতলতা ঠিক টানছে না। শরীরে রক্ত আছে কি-না তা-ও বেখবর। উনুনে রান্না চড়িয়ে ভাবছি রান্না শেষ হবে তো! কত রান্না-ই তো কত জন শেষ করতে পারেনি! স্বপ্ন ছিল তাঁদেরও অস্থিমজ্জায়। অথচ তুলশি গঙ্গায় এখন হাঁটু পানি- স্বপ্নও ভাসে না ওখানে।
বেশরম হয়ে, মাথা নিচু করে বেঁচে থাকা- আমাদের এই শহরে। অথচ এখানেও বৃষ্টি হচ্ছে, হিমেল হাওয়া বইছে, দূরে তালগাছ হেলেদুলে হাওয়া খাচ্ছে। এখনো মালবাহী গাড়িগুলো মাঝে মাঝে হুইসেল বাজিয়ে অনায়াসে পাড়ি দিচ্ছে। অথচ নিপাট ভদ্রলোকের মতো দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্টগুলো, রেলস্টেশনের অদূরের ফুটওভার ব্রিজটিও। তবে শুনেছি,কোনো মকসুদ ছাড়াই তুমুল আড্ডার রাতুল বেকারি নাকি এখন বন্ধ! জম্পেশ আড্ডার সারথিরা কই?
মিতুলি নামের বকুল ফুলের গাছটি কি এখনো মোহনীয় গন্ধে মাতাল করে? রাহাবর হয়ে জেগে থাকে? মিতুলির সাথে আমার সখ্য বেশ পুরনো! কত কথা-ই না আমাদের হতো! কত সখ, কত আহ্লাদ, কত গোপন ইচ্ছের পাততাড়ি গুটিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছিল ও। ওখানে দাঁড়িয়েই আমি প্রথম অরুন্ধতী দেখতে শিখেছিলাম। এত ম্লানমুখে আকাশে ওঠবার কি প্রয়োজন ছিল তার!
রেলপথের ধারেই বারঘাটি পুকর! তারই ঘাটে যৌবনের তরঙ্গে লোলায়মান যেন সকল ভবিষ্যৎ! বাঁশির সুর, গিটারের টুংটাং, হুল্লোড় আর মনভাঙা বিষাদের রূপ- একই সাথে বেজে ওঠে ওখানে। থেমে থেমে হাইজ্যাক হওয়া স্বপ্নরা ভীড় জমায় । মাঝে মাঝে বোধ হয় স্বৈরী হয়ে উঠি। নেমে যাই ওদের তরঙ্গে- ব্যর্থতার গল্পও কখনো কখনো সোনালি ভোরের সন্ধান দেয়!
নাচদুয়ার বন্ধ হয়ে যাবার পরও কতোদিন যে নেমে গেছি! দাঁড়িয়েছি বারো ঘাটির পাড়ে! মাহবুব আর শাকিল- ইতিহাস, দর্শন, স্পিরিচুয়ালিটি- কত কথা যে হতো তাদের সাথে! ওদের অনবরত কথা আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম!
আবদুল জলিল স্যারের স্কুটিতে মধ্যরাতের শহর ঘোরা আর গরম মিষ্টির লোভ আমাকে এখনো তাড়া করে ফেরে। স্যারের সাথে কত বিচিত্র বিষয়ে যে তর্ক হতো- ভাবলে অবাক হই!
সেদিন রাত প্রায় একটা ছুঁইছুঁই, ফিরছি ছোট যমুনার একটা ব্রিজ দেখে। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। জলিল স্যারের স্কুটির পেছনে বসেই তর্ক চলছে! হঠাৎই স্কুটির স্টার্ট বন্ধ। সে আর আমাকে নিয়ে আসবে না! বললাম ” উচিৎ কথা বললে, চাচা লায়েত থে’ নামো?”
আবার হাসাহাসি!
এখন অন্যদের ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ি। ভাবি – এ-ও মানুষের জন্ম হয়? মিথ্যাকে কি অবলীলায় ধারণ করে চলেছে এরা! বলছে এমনভাবে যেন আমরা ক্রসচেক না করেই বিশ্বাস করে নেবো! কিংবা নেয়া উচিত!
ভাবছি – এত ঘৃণা তারা কীভাবে লালন করে? কীভাবে গালি দেয় একে অন্যকে! অথচ ওরা সবাই জানে মিথ্যা কে বলছে! শান্তির জন্য মিউট করে দেই তাদের! বিখ্যাতদের ওয়াল থেকে চুপিসারে সরে যায়, যেন দেখিনি! মেরুদণ্ডহীনদের কথা শুনলে নিজেকে অশুচি লাগে কেন! বড় অস্বস্তি বোধ হয়! মিথ্যাও এত জেল্লাদার হতে পারে!
কোভিড-১৯ তুমি বাংলাদেশে বিস্ময় হয়ে এসেছো! আমাকে বন্দী করে হাজতের কুঠুরিতে নিক্ষেপ করেছো! আজ তো সাতদিনই হলো, না!
এখানে কতদিন মানুষ দেখি না; মানুষ নামের জঙ্গলগুলোর কথা শুনি শুধু। আর শুনি তপ্তরোদে ঘেমে-নেয়ে একাকার হওয়া পরিবারের ঘানি টানা মানুষগুলোর হাহাকার! চিত্রকরের কারুকাজে সজ্জিত উল্টে থাকা রিকশাগুলো দেখি, সাথে চলমান পৃথিবীর ফাইনেস্ট মডেলের গাড়িগুলো।
খবর। দুর্নীতি। হসপিটাল। এ্যাম্বুলেন্স। অক্সিজেন। আইসিইউ। গোরস্থান। হাহাকার… নিপাত যাক।
আমাকে শান্তিময় মৃত্যু দিও প্রভু। ক্ষমা করে দিও।