পোশাক শিল্পে মানবিক সংকট

নিজস্ব প্রতিবেদক/ করোনা মহামারি দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কার্যাদেশ কমে গেছে। কমে গেছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। চাকরিচ্যুত হয়েছে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। ভয়াবহ করোনাভাইরাস কোভিড-১৯-এর আঘাতে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি মানবিকতাও সংকটে পড়েছে। চাকরিচ্যুতির লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে সন্তানসম্ভবা নারী, শ্রমিক ও তুলনামূলক দুর্বল শ্রমিকরা। করোনাকালীন চাকরিচ্যুতি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এমন চিত্র মিলছে। কোভিড-১৯-এর কারণে আইরিস কারখানাটি বন্ধ হওয়ার অন্যান্য কারখানার সঙ্গেই মে মাসে খোলে।

খোলার পরপরই সন্তানসম্ভবা চারজন নারী শ্রমিককে রিজাইন করতে বাধ্য করে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেন গাজীপুরের সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি সামসুন্নাহার। ছাঁটাইয়ের শিকার চার নারী শ্রমিক অভিযোগ করেন তাদের জোর করে ছাঁটাই করা হয়েছে। অন্যদিকে কারখানা থেকে জানানো হয় তারা রিজাইন করে চলে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারখানায় আগের চেয়ে এখন বেশি কাজ আছে।

কোভিড-১৯-এর আগে যে সময় ধরে শ্রমিকদের ডিউটি করানো হতো, এখন তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ডিউটি করানো হয়। করোনার অজুহাতে সন্তানসম্ভবা ও শারীরিকভাবে দুর্বল শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত গড়ায়। তারপরও চার নারী শ্রমিকের মাতৃকালীন সুবিধা মেলেনি। কোভিড-১৯-এর অজুহাতে সন্তানসম্ভবা নারী শ্রমিক, শারীরিকভাবে দুর্বল ও ট্রেড ইউনিয়ন করার চেষ্টা করেছে- এমন প্রায় তিন হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করে গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট তৈরি পোশাক শিল্প গ্রুপ। এর মধ্যে ৫৩৬ জন সন্তানসম্ভবা নারী শ্রমিক।

কারখানাটির মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এসব শ্রমিক ঈদের আগে ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললে শিল্প পুলিশ কারখানা অধিদফতর ও মালিক পক্ষ মিলে নারী শ্রমিকদের মাতৃকালীন ছুটির সুবিধাদিসহ চাকরি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

রিজাইনজনিত পাওনা পায় আরও প্রায় ২০০ শ্রমিক। অন্যান্য ২০৮০ জন শ্রমিক বহুপক্ষীয় বৈঠকের আগেই রিজাইন করে চলে যাওয়ার কারণে তারা সকল সুবিধাদি পায়নি। সাভারের সিগমাসহ পাঁচ শতাধিক কারখানায় সন্তানসম্ভবা, তুলনামূলক শারীরিকভাবে দুর্বল ও বিভিন্ন কারণে চাকরিচ্যুত করেছে। এসব কারখানার অধিকাংশেরই কার্যাদেশ না কমলেও কোভিড-১৯-এর অজুহাত তুলে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এসব কারখানার যেখানে শ্রমিকরা আন্দোলন গড়ে তুলেছে তারা কেউ কেউ চাকরি ফিরে পেয়েছে, যারা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বা কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ করতে পারেনি তা পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা যাবে না- এমন শর্তে উদ্যোক্তাদের দুই দফায় সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। তারপরও কোনো সক্ষম কারখানা শ্রমিক চাকরিচ্যুত করলে সেগুলো চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে বলে জানান মহিলা শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি সামসুন্নাহার এমপি।

করোনার অজুহাতে আগের যে কানো সময়ের চেয়ে শ্রমিকদের ওপর জুলুম অত্যাচার বেড়েছে বলে মনে করেন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী সভাপতি কাজী রুহুল আমিন।

তিনি বলেন, করোনার অজুহাতে গার্মেন্ট কারখানা মালিকরা একই সঙ্গে আইনি ও মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এ অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলে অনেকগুলো কারখানায় চাকরি ফিরিয়ে দিয়েছি। কোনো কোনো কারখানায় আইন অনুযায়ী পাওনাও নিশ্চিত করেছি। কিন্তু যেসব শ্রমিক চাকরিচ্যুত হওয়ার কারণে চলে গেছে তাদের পাওনা নিশ্চিত করা যায়নি।

তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য দুই দফায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটির টাকাও দেওয়া হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্যই ছিল এসব শ্রমিককে যেন চাকরিচ্যুত না করে, সময় মতো বেতন দেয়। কিন্তু লক্ষাধিক শ্রমিককে কর্মহীন করার পাশাপাশি তুলনামূলক ভালো, সক্ষম এ রকম পাঁচ শতাধিক কারখানা সন্তানসম্ভবা নারী শ্রমিক ও বিভিন্ন কারণে টার্গেট করে রাখা শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।