অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বড়াইগ্রামের চিনিডাঙ্গার বিল

ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন/
নাটোর জেলার বড়াইগ্রামে চিনিডাঙ্গার বিল। বিলের ঘন কালো পানিতে শোভা পাচ্ছে রাশি রাশি পদ্ম ফুল। ‘যেখানে পদ্ম ফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে’। হাজারো দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখরিত এ বিল হয়ে উঠেছে অপার সম্ভাবনাময়।
বনপাড়া গোল চত্বর থেকে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক ধরে পাঁচ কিলোমিটার এগুলেই পারকোল বাজার। ডানদিকের এ বাজার ধরে এক কিলোমিটার পথ পেরুলেই কাংখিত চিনিডাঙ্গার বিল। পথের দুই পাশ জুড়ে মৎস্যজীবীদের অবস্থান-জিয়নপাড়া। এ মৎস্যজীবীরাই বিলের প্রাণ। এ পেশাজীবীরা ভালো থাকলে বিল হয়ে ওঠে ঝলমলে। শান্ত স্নিগ্ধ বিলে ফোটে ফুল, গান করে পাখি।
জিয়নপাড়ার শেষ প্রান্তে কাশফুলের বনে রাখা আছে অসংখ্য নৌকা। ইঞ্জিন চালিত না হওয়াতে শুধু বৈঠা সহযোগে নিঃশব্দ বয়ে চলা এসব নৌকা শতভাগ পরিবেশ-বান্ধব! বিলময় নাটোর জেলার অন্য সব বিল থেকে এই বিলকে বিশেষত্ব দিয়েছে- এ বিলের বৈঠা চালিত নৌকা। বিলের মধ্যে নীরব অহংকারে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পক্ষীকূলের আশ্রয় ও খাদ্য নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের নামফলক সম্বলিত আশ্রয়কেন্দ্র। বৃষ্টির দিনে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এই ভবনই হয়ে ওঠে দর্শনার্থীদের আশ্রয়স্থল। অন্তহীন বিলের কালো পানিতে গোলাপী রঙের রাশি রাশি পদ্ম। শরতের শুরুতে পদ্মগুলো ফুটতে শুরু করেছে। পদ্মের বিশাল পাতাগুলোতে টলমল করছে পারদের মত পানির দলা! পাতার পানির দলাগুলো ভারসাম্য হারিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিলের পানিতে। এ যেন ‘জীবন যেন পদ্ম পাতায় শিশির বিন্দু’র মূর্ত প্রতিচ্ছবি! ফুলের কানে গুঞ্জন করছে ভ্রমরের দল। আর পাতার উপরে সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছে সাপ। তবে মধু আহরনে ব্যস্ত ভ্রমরের সাথে ফনা তোলা সাপের খেলা সময়ের সল্পতায় দেখা হয়ে ওঠেনি। অনাগত দর্শনার্থীল জন্যেই হয়তো ঐ আনন্দ অপেক্ষা করছে!জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দর্শনার্থীদের আগমনে জমজমাট থাকে পদ্ম বিল। কিছুদিন পরে পরিযায়ীসহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আগমন ঘটবে। সন্ধ্যার পরে আকাশ জুড়ে জ্যোছনার উপস্থিতি আর পাখিদের কলতানে বিল হবে আরো মায়াবী। সামনের দিনে আরো ফুল ফুটবে, পাখি গান গাবে, তাই আবারো জ্যোছনা রাতে বিল দেখতে আসার আকুতি নাটোর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দুই বোন আলভী আর মুনতাহার।
এই শরতে বিলে ভিড় করতে শুরু করেছেন দর্শনার্থীরা। তাদের জন্যে আছে ভাড়াতে নৌকার ব্যবস্থা। কর্ম হারানোর বেদনায় থাকা এলাকার মৎস্যজীবীদের অনেকেই বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে নৌকায় দর্শনার্থীদের বিল দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ঘাটে নৌকা আছে পারকোল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিরও। এ নৌকায় বসে কথা হয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে। তাঁরা জানালেন, বড়াইগ্রাম উপজেলার পারকোল, মালিপাড়া আর আটোয়ার পাশ জুড়ে বিশাল এ বিলের অবস্থান। বিশাল এ বিলের মধ্যে প্রায় পাঁচশত একর জলকর সরকারী খাস খতিয়ানভূক্ত। বিলের মধ্যে দবিলা এলাকায় আছে পঞ্চাশ একরের এসএ রেকর্ডভূক্ত খাস খতিয়ানভুক্ত দিঘী। এ দিঘীই এক সময় ছিল এ বিলের চারপাশ জুড়ে থাকা প্রায় সাড়ে চার হাজার মৎস্যজীবীর আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকারের পক্ষে এলাকার মৎস্যজীবীরা লড়াই করেও এ দিঘী রক্ষা করতে পারেননি। দুষ্টুচক্রের সহযোগিতায় আর এস রেকর্ডে এ দিঘীর বেশ কিছু অংশ অবৈধভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভূক্ত এবং কেনাবেচাও হয়ে গেছে। অবশিষ্ট বিল নাব্যতা হারিয়েছে। অথচ এ বিল খনন করে তৈরী করা যেত মা মাছের অভয়াশ্রম। এ অভয়াশ্রম থেকে সারা বিলে ছড়িয়ে পড়তো মাছের পোনা। সারা বিল হয়ে উঠতো মৎস্যজীবীদের মাছের আধার। মৎস্য বিভাগ প্রতি মৌসুমে বিলে মাত্র দুই মণ মাছের পোনা ছেড়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে।
এই বিলের এক সময়কার সভাপতি আজিজুল ইসলাম, পারকোল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইসলাম উদ্দিনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের দাবি, বিলের দিঘী অবৈধ রেকর্ডভুক্তির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে দিঘী খনন করে মাছের অভয়াশ্রম তৈরী করতে হবে। উপজেলার ৬৪টি খাস জলাশয় প্রকৃত মৎস্যঝবিীদের নামে ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রশাসনকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পক্ষিকূলের আশ্রয় ও খাদ্য নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের সমন্বয়কারী যশোধন প্রামানিক বলেন, দেশের সকল জলাশয় তথা বিলগুলোকে মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার চেস্টা চলছে।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবু রায়হান জানান, মৎস্যজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে নাটোরের চিনিডাঙ্গার বিলে সাত কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭৫ বিঘার একটি দিঘী পুনঃখনন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ বাসস’কে বলেন, চিনিডাঙ্গার বিলে মৎস্যজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে সর রকমের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের বিল ভ্রমণ সহজ ও সুন্দর করতে প্রশাসন সচেস্ট থাকবে। (বাসস)