সমঝদার সাহেবের আক্কেল

মারুফ  হোসেন/

পিংপং খেলতে গিয়ে আক্কেল দাঁত হারালেন বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা। ঢাকার গুলশানে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় এই বিরল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন জনাব গোলাম কুরেশি সমঝদার। জানা গেছে সমঝদার সাহেব প্রতিদিনকার মতন বিকেলে কাজকর্ম কোনোরকম সেরেই দ্রুত টেবিল টেনিস খেলতে যান। খেলার এক পর্যায়ে উত্তেজনায় তার মুখ বড় রকম ‘হা’ হয়ে যায়। এই সময় প্রতিপক্ষ সুযোগ বুঝে স্পিন মার দিলে পিংপং বলটি সমঝদার সাহেবের ‘হা’ মুখ দিয়ে ঢুকে দাঁতের সারির শেষপ্রান্তে আঘাত হানে। সঙ্গে সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত সমঝদার সাহেব ‘বাবাগো মাগো’ চিৎকার দিয়ে পিংপং টেবিলে লুটিয়ে পড়েন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

তিনি আর খেলার মতো অবস্থায় না থাকায় খেলাটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন রেফারি। এতে প্রতিপক্ষ উষ্মা প্রকাশ করলেও রেফারি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরবর্তীতে সমঝদার সাহেবকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলে দন্তচিকিৎসক উনার আক্কেল দাঁতটি ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। একদিকে দাঁত হারাবার বেদনা অন্যদিকে আক্কেল কমে যাবার ভয়ে সমঝদার সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত উনি হারানো দাঁত হাতে নিয়ে কিছু ফটোসেশন করলেও চরম মুষড়ে পড়ে শুধু দুধে ডুবিয়ে পাউরুটি খাচ্ছেন বলে উনার এক কাছের আত্মীয় জানিয়েছেন।

******

গতকাল দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘পিংপং-এ আক্কেল গুড়ুম’ শীর্ষক সংবাদটি নিয়ে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। খবরটি প্রকাশের পরপরই সর্বত্র, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি ঝড় তোলে। বেশীরভাগ মানুষ জনাব গোলাম কুরেশি সমঝদারের অদ্ভুত দুর্ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে তাঁর দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। কিন্তু কতিপয় অবিবেচক বিষয়টি নিয়ে ফেইসবুকে হাসিঠাট্টায় লিপ্ত হয়। পিংপং বলের আঘাতে আক্কেল দাঁত হারানো আদৌ সম্ভব কি না, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়াসেও আছেন অনেকে।

সমঝদার সাহেবের মুখের ও মনের প্রচণ্ড ব্যথাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুখরোচক ট্রল প্রচারে তাদের কাছে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বিশেষ করে সমঝদার সাহেবের ঘনিষ্ঠ দু’একজন বন্ধু অদূরদর্শিতার নজির গড়ে এ বিষয়ে তামাশা করে রসালো লেখা এবং ভিডিও প্রকাশ করবার পরই বিষয়টি ভাইরাল হয়। সবকিছু নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জনাব সমঝদার ফুলে ঢোল হওয়া গাল দেখিয়ে বলেন, “আমার দুর্দশা নিয়ে আজ যারা মজা নিচ্ছে, তারা সবাই অর্বাচীন। খবর যারা রঙ চড়িয়ে চটকদার করে ফেসবুকে দেয়, তারা একদম মূর্খ। আর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কথা কি আর বলব। এরা আমার বন্ধু হলে আল্লা জানে আমার শত্রু কারা।” এ পর্যায়ে প্রতিবেদক উনার কাছে ‘অর্বাচীন’ শব্দের অর্থ জানতে চাইলে তিনি আমতা-আমতা করে এড়িয়ে যান।

জনাব সমঝদারের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তিনি আক্কেল হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে আক্কেলশূন্যতার চেয়েও তাঁকে বেশী পীড়া দিচ্ছে খেতে ভালো-মন্দ খেতে না পারাটা। ভোজনরসিক সমঝদার সাহেব আগে প্রায়ই দেশী মুরগীর হাড়সুদ্ধ চিবিয়ে খেতেন। গরু-খাসীর মাংসও হাড়সুদ্ধ চিবিয়ে খাওয়াতে নাকি উনার জুড়ি নেই। কিন্তু আক্কেল না থাকলে হাড্ডি তো দূরের কথা, দুধে পাউরুটি ডুবিয়ে খাওয়াও দেখতে যত সহজ, খেতে তত সহজ নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এদিকে এই দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে জনাব সমঝদারের কর্মস্থলে টেবিল টেনিস খেলা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে টেবিল টেনিসপ্রিয় সহকর্মীবৃন্দের অনেকের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকে মুখ বাঁকিয়ে নিচু গলায় বলেছেন যে সমঝদার সাহেবের এই কথিত আক্কেল দাঁত হারানোর দাবী ভন্ডামী ছাড়া কিছু নয়। তারা মুখ বাঁকিয়ে এও বলেন যে একটু আক্কেল থাকলেই আর দাঁত হারাতে হত না।

****

ঘটনার তৃতীয় দিনে নাটকীয় মোড় নিয়েছে জনাব গোলাম কুরেশি সমঝদারের আক্কেল দাঁত সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহ। দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাতারাতি ‘হটকেক’ হয়ে পড়া জনাব সমঝদার গতকাল সকালে ব্যক্তিগত ফেইসবুক প্রোফাইলে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস আপডেটে জানান যে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। তবে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ায় তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে তিনি মিডিয়াকে দোষারোপ করেন। তিনি বলেন, এতদিনে বুঝেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কষ্ট। সব মিডিয়াই আসলে ‘ফেইক নিউজ’। সব খবর বানোয়াট। সব সংবাদ বাকওয়াস। এইসব ফেইক নিউজের তিনি ‘খেতা পুরেন’। স্ট্যাটাসের শেষে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম হ্যাশট্যাগে যুক্ত করেন।

এর চার ঘন্টার মাথায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং নিজের টুইটার একাউন্টে জনাব গোলাম কুরেশি সমঝদারের স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট টুইট করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উছ্বাস প্রকাশ করে বলেন যে, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রগতিশীল বিশ্বনীতি এবং জনপ্রিয়তার প্রমান জনাব সমঝদারের এই সমর্থন। সারা পৃথিবীর সব সংবাদই আসলে ফেইক নিউজ। সুদূর দক্ষিণ এশিয়ায় কখনও যাবার সুযোগ হলে তিনি জনাব গোলাম কুরেশি সমঝদারের মত বিচক্ষণ ব্যক্তির সঙ্গে অবশ্যই দেখা করতে চাইবেন।

ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজপথ হতে বিতাড়িত সরকারবিরোধী দল এক বিবৃতিতে বলে যে, দেশের মিডিয়া পুরোপুরি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। তাদের সব খবর যে মিথ্যা এবং বানোয়াট হবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। ট্রাম্প সাহেবের কথাই প্রমান করে দিল বিশ্বদরবারে দেশের ভাবমূর্তি এখন কেমন।

এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের টুইটের প্রেক্ষিতে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থান কোনটি হবে তা সরকার এখনও মনস্থির করতে পারে নি বলে জানা গেছে।

তবে কোনরকম দ্বিধার কথা নাকচ করে দিয়ে সরকারি মুখপাত্র বলেন, গুজবে একদম কান দেবেন না। দেশে কোন বিরোধী দল নেই। সব মিডিয়ার সৃষ্টি। অবশ্য তিনি জনাব গোলাম কুরেশি সমঝদার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি। এর পরপরই জনাব সমঝদারের বাসায় সরকারের উপরমহলের কিছু নেতৃবৃন্দ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের আনাগোনা দেখা যায়।

******

কথায় বলে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। নিজেদের কোম্পানির কর্মকর্তার রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়াটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাচ্ছে জনাব সমঝদারের চাকরিদাতা বহুজাতিক কোম্পানিটি। ইতিমধ্যেই তারা গোলাম কুরেশি সমঝদার নামটির আদ্যাক্ষর ব্যবহার করে ‘জিকিউএস পাউরুটি’ নামে একটি নতুন খাদ্যপণ্য বাজারে নামাবার জন্য বিএসটিআইয়ের কাছে আবেদন করেছে। এই পাউরুটি সাধারন পাউরুটির তুলনায় অন্তত দ্বিগুন নরম বলে দাবি এই প্রতিষ্ঠানের। সচেতন ভোক্তারা এই পণ্য লুফে নেবেন বলে আশাবাদ জানিয়েছেন কোম্পানির শীর্ষ এক কর্মকর্তা।

অবশ্য সমঝদার সাহেবকে নিজেদের ব্র্যান্ড এমব্যাসেডর হিসেবে পেতে তাদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হবে না ভাবলে বড় ভুল করবে কোম্পানিটি। পাউরুটি প্রস্তুতকারী আরও কিছু বড় প্রতিষ্ঠান সমঝদার সাহেবকে নিজেদের পাউরুটির মোড়কে আনতে মোটা অংকের টাকা ঢালবার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে।

এই সব ঘনঘটার মধ্যেও নিন্দুকেরা মুখ বন্ধ রাখে নি। একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে সমঝদার সাহেবের অফিসের কেরানী নাকি পাউরুটি নিয়ে মাতামাটিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলেছেন। কেরানীর বক্তব্য, স্যারের (সমঝদার সাহেব) পাউরুটিপ্রীতি তো নতুন কিছু নয়। আক্কেল হারাবার আগে গরম চায়ে পাউরুটি ডুবিয়ে খেতেন, এখন দুধে ডুবিয়ে খান। এই তো পার্থক্য। (লেখক- কানাডা প্রবাসী)