শ্রমিক আন্দোলনে পাল বাবু এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

স্বপন কুমার পাল/

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শ্রমিক নেতা স্বর্গীয় সুশীল কুমার পালের (পাল বাবু) ৩৬তম মৃত্যু বার্ষিকী ছিল ২৩ জুলাই। শ্রমিক নেতা প্রয়াত সুশীল কুমার পালকে স্মরণ করতে হয়। যিনি গোপালপুর, লালপুর তথা নাটোরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও রাজনীতির সাথে এক হয়ে রয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। তিনি নাটোরের গুরুদাসপুর থানার কাছিকাটা গ্রামে এক সাধারণ পরিবারে ১৯২৯ সালের ১লা জানুয়ারী তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন দুরন্ত-দুর্বার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ছাত্র অবস্থায় পিতা ফকির চাঁদ পাল মহাশয়ের নিকট থেকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের আনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন। যদিও মায়ের বাধার কারণে সে আন্দোলনে যোগ দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু সেই থেকে তাঁর মানসিকতা গড়ে উঠে হতভাগ্য, বঞ্চিত, নিপীড়িতদের উদ্ধারের জন্য। খেটে খাওয়া মানুষের ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত হওয়ার চিত্র দেখে তিনি হয়ে উঠেন প্রতিবাদী। যার সফল প্রকাশ দেখা যায় বাংলাদেশের চিনিকল শ্রমিক আন্দোলনে।
প্রখ্যাত এই শ্রমিক নেতা ১৯৪৫ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৫১ সালে চাকুরীর অন্বেষায় আসেন নাটোরের গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে। তখন সুগার মিল ছিল ব্যক্তি মালিকানায়। আর সঙ্গত কারণেই ছিল অল্প মজুরী, বেশী শ্রম। তিনি শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে মালিকের নিকট পেশ করলে মালিক ক্ষুব্ধ হন। দাবী মানতে রাজী না হলে তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় কর্মবিরতি, ধর্মঘট ইত্যাদি। তিনি গ্রহণ করেন মালিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ, ন্যায্য দাবী আদায়ের বজ্র কঠিন শপথ এবং অনুভব করেন ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের। শুরু হয় দেশব্যাপী যোগাযোগ তারপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। মালিকের অজান্তে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিষ্ট্রি হয় অত্যন্ত গোপনে। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন হলে মালিক তাঁকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি, আদালতে মামলা করে সকল দাবী আদায় করেন। কিন্তু চাকুরী ফিরে পাননি। তবুও নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের শ্রমিক কর্মচারী সকলেই তাদের মাথার মণি করে তাঁকে ইউনিয়নের একজন উপদেষ্টা হিসেবে মাসিক চাঁদা ধার্য করে বেতন দিয়ে রেখে দিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ চলাকালে বিদ্বেষবশতঃ তৎকালীন সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেন এবং সকল হিন্দু শ্রমিক কর্মচারীকে চাকুরী থেকে ছাঁটাই করেন। ৬ মাস পরে জেল থেকে মুক্ত হয়ে মোকাদ্দমার মাধ্যমে সকল হিন্দু শ্রমিক-কর্মচারীর চাকুরী ফিরিয়ে আনেন। তাঁর দৃঢ়তার জন্য, সৎ সাহসিকতা ও ন্যায্য দাবী আদায়ের প্রতিষ্ঠায় তিনি হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠলেন। সুশীল কুমার পাল ট্রেড ইউনিয়নকে আরও শক্তিশালী করতে ১৯৫৬ সালে কলকাতার নিউ আলীপুরে এশিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন কলেজ থেকে ১২ সপ্তাহের ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করেন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে চলতে থাকে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ট্রেড ইউনিয়ন। ইতোমধ্যে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। তিনি তাঁর শ্রমিক সংগঠনকে নিয়ে সেই আন্দোলন সংগ্রামে পুরোদমে জড়িয়ে পড়েন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরো বেগবান করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণা ও উৎসাহদাতা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে শান্টিং রেলগাড়ী দিয়ে গোপালপুর রেলগেট অবরোধ করে পাক-সেনাদের গাড়ি বহরকে গোপালপুরে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করেন, ফলে পাক-সেনারা ফিরে যেতে বাধ্য হয় এবং পাক সেনাদের বিমান উঠা নামায় ব্যঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে বুলডোজার চালিয়ে ঈশ্বরদী এয়ারপোর্টের রানওয়ে ভাংচুরের নেতৃত্ব দান করেন (বুলডোজার চালক ছিলেন মৃত সামসুদ্দীন মিয়া, বর্তমান ঠিকানা কলেজ পাড়া, গোপালপুর, নাটোর এবং তাঁর সহকারী ছিলেন গোপাল সিং যিনি এখন জীবিত আছেন)। দেশ যখন আন্দোলনকারীদের দখলে, তখন নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের মনি ড্রাইভার এর জীপ গাড়িতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে নাটোরের এ.ডি.সি’র কাছ থেকে জেল হাজতের চাবি নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে আটক ছাত্র জনতা সহ সমস্ত বন্দীকে মুক্ত করে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উৎসাহদান করেন।
স্বাধীনতার পর ট্রেড ইউনিয়নকে আরও সুসংগঠিত করার জন্য তিনি এশিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন কলেজ, নিউ দিল্লী, ইন্ডিয়া থেকে ট্রেড ইউনিয়ন লিডারশিপ এ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিয়াল রিলেসন্স’- এর উপরে ১৯৭২ সালে ৪ সপ্তাহের একটি ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে অনুষ্ঠিত আই.এল.ও’র রিজিওনাল কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের আমন্ত্রণে সেই দেশ সফর করেন এবং নিউইয়র্কের ইথাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এ্যান্ড লেবার রিলেসন্স’- এর উপরে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে সি.জি.টি’র আমন্ত্রণে ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করেন। ট্রেড ইউনিয়ন জীবনে তিনি ১৯৫৩ সালে ইষ্ট পাকিস্তান সুগার মিলস্ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ব্রান্স সেক্রেটারি নিযুক্ত হন, ১৯৫৭ সালে ইষ্ট পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার এর এক্সিকিউটিভ মেম্বার নিযুক্ত হন,
১৯৬৪ সালে ইষ্ট পাকিস্তান লেবার এ্যাডভাইজরি বোর্ডের মেম্বার পদ অধিকার করেন, ১৯৬৮ সালে এবং পুনরায় ১৯৭৭ সালে রাজশাহী লেবার কোর্টের মেম্বার নিযুক্ত হন, ১৯৭২ সালে জাতীয় শ্রমিক লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, ১৯৭৫ সালে শ্রমিক ফ্রন্ট থেকে ‘বাকশাল’ কেন্দ্রীয় কমিটি’র সদস্য নিযুক্ত হন, এছাড়াও তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রাজশাহীর রেশম শিল্প এমপ্লয়ীজ এ্যাসোসিয়েশন, আজিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরী ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন এবং পাবনার ইক্ষু গবেষণা এমপ্লয়ীজ এ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করেন। শ্রমিক স্বার্থ আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে সরকারের রোষানলে পড়ে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে কারাবরণও করতে হয়েছে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ মাস এবং ১৯৮৩ সালে সৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার হন এবং ৪ মাস কারাভোগ করেন।
শ্রমিকদের এই অকৃত্রিম বন্ধু, অকুতোভয় মহান শ্রমিক নেতা সুশীল কুমার পাল ১৯৮৪ সালের ২৩ জুলাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আকস্মিকভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ মহাশ্মশানে স্বর্গীয় সুশীল কুমার পালের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ একটি স্মৃতিবেদি নির্মাণ করেন, সেখানে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হয়।