বর্ষাপ্রেম

কনক কুমার প্রামানিক ::
অনুর খুব রাগ হচ্ছিল অয়নের উপর। সেই ১টা থেকে ওর জন্য পার্কে বসে অপেক্ষা করছে সে। এখন ঘড়িতে বাজে পুরো আড়াইটা। সময় সম্পর্কে তার জ্ঞান খুব কম। একে তো লোকজন কেমন যেন আড়চোখে ওকে দেখছে। তার উপর ঝির ঝির বৃষ্টি হচ্ছে শিশিরের মতো। লোকগুলো তাকে এমন ভাবে দেখছে মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আস্ত গিলে খাবে তাকে। এমন বাজে স্বভাবের লোকগুলো বোধ হয় কখনো মেয়ে মানুষ দেখেনি। ওদের বাড়িতে মা বোনও নেই। তাই হয়তো সবাইকে বউ আর গার্লফ্রেন্ড ভাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে অয়ন এসে পেছন থেকে একহাতে অনুর চোখ চেপে ধরে। অনু প্রথমে খানিকটা ভড়কে গেলেও পরক্ষণে হাতটা তার পরিচিত মনে হয়। এ হাতের ঘ্রাণ তার খুব পরিচিত। খানিকটা দূরে সরে গিয়ে মেকি অভিমান করে অনু। আর ঠিক তখনই পেছন থেকে একখানা হাত বের করে মুঠোভর্তি কদম এগিয়ে দেয় অয়ন। একদম নিমিষেই রাগ গলে জল। কদম অনুর অনেক পছন্দের ফুল। অনেক ভালোবাসে সে কদম ফুলটাকে। এমনই এক বর্ষার দিনে ওদের দু’জনের দুই হৃদয় এক হয়েছিল। অয়ন আসার পর বেজন্মা কুকুরগুলো চলে গেছে। আবার অন্য কোন স্থানে নতুন কাউকে উত্যক্ত করবে। অনু আজ ম্যাচিং করে নীল শাড়ি পড়ে এসেছে। নীল অয়নের প্রিয় রং। দারুণ লাগছে ওকে। যেন এক নীলকন্ঠ পাখি। নীল শাড়ি পরলে অয়ন অনুকে নীলকন্ঠী বলে ডাকে। চোখ ফেরাতে পারছে না অয়ন। অনুর দিকে তাকিয়েই আছে। লজ্জায় অনু দু’হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। ফর্সা ছিপছিপে দেহখানি যেন লজ্জায় লাল হয়ে যায়। অয়ন ওর খাড়া সরু নাকখানা টেনে দিয়ে বলে, Happy Anniversary আমার নীলকন্ঠী। অনুও প্রতিউত্তর করে। আজ ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। আরো কিছু সময় ওরা পার্কে অতিবাহিত করে। অনুর প্রিয় মটন বিরিয়ানি দিয়ে লাঞ্চ সারে।ওরা। হেড অফিস থেকে অডিট এসেছিলো তাই অয়নের আসতে কিছুটা দেরি হয়েছে। আর সে কারণে ছুটিও নিতে পারেনি। অফিসের বস বলে কথা। অডিট হলে প্রধানকে তো থাকতেই হয়। কদমফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে অনুর মনে পরে গেল প্রায় বছর দেড়েক আগের কথা। সেদিন তো সে মারাই যাচ্ছিল। অয়নের সাহসিকতায় সেদিন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল সে। সেদিনের কথা কিভাবে ভুলবে সে। তখনো অয়নের চাকুরী হয়নি। সবে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস এর প্রিপারেশন নিচ্ছে। রিকসা করে ভার্সিটিতে যাচ্ছিল অনু। অয়নও বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল। পথিমধ্যে অনুর ওড়না রিকসার চাকায় পেঁচিয়ে যায়। সামনে থেকে বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে আসে একটি ট্রাক। তৎক্ষণাৎ সেদিকে দৃষ্টি যায় অয়নের। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দ্রুত রিকসাটাকে থামিয়ে চাকা থেকে ওড়না খুলে দেয়। প্রাণে বেঁচে যায় অনু। অয়নকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায় অনু। দিন পনেরো এভাবে কেটে যায়। দু’ জনের আর দেখা হয়না। এ ঘটনার পর অয়ন ও অনুর জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। কয়েকদিন ঘুমাতেও পারেনা দু’জন। মাসখানেক পর প্রথম শ্রেণির ভালো একটা চাকুরী পায় অয়ন। লাইব্রেরির কিছু বই ফেরত দিতে একদিন ভার্সিটিতে আসে অয়ন। সেখানে আবার দেখা হয় ওদের দু’জনের। নিরব নিস্তব্ধ এক পরিবেশ। কারো মুখে কোন কথা নেই। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। ভালোলাগা হলো আঁখির শিল্পদৃষ্টি আর ভালোবাসা অন্তরের সুখানুভূতি। বিয়ে হলো হ্রাস আকর্ষণের দৃঢ় বন্ধন। চকিত সম্বিৎ ফিরে আসে দু’জনের। অব্যক্ত কথাগুলো ফুলকি হয়ে ঝরতে থাকে। আনন্দে চার চোখের কোণায় অশ্রুবিন্দু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর বিয়ে। গত বছর আজকের এই দিনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ওরা। পার্ক থেকে বের হয়ে রিকসা নিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে দু’জন। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে মনের সুখে ভিজে। সন্ধ্যায় যখন ওরা বাসায় ফিরে আসে,গোধূলির রক্তিম ক্লান্ত সূর্যটা তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে।