পর্ণির বিড়াল

নবী হোসেন নবীন//

কুকুর বিড়াল আমার দুটি অপছন্দের প্রাণী। বিড়াল অপছন্দের কারণ হলো এটি খাবার সময় খুব বিরক্ত করে, শীতকালে লেপের নিচে ঘুমায়, বিছানায় পেশাব করে আর ধানের গোলায় মল ত্যাগ করে। কুকুর অপছন্দ করি এ কারণে যে এরা বাড়িতে মেহমান এলে অপ্রয়োজনে ঘেউ ঘেউ করে ও যথায় তথায় মল ত্যাগ করে পরিবেশ নষ্ট করে। একদিন রাতের খাবার খেতে বসেছি এমন সময় একটা বিড়াল ছানা একেবারে কাছে এসে মিউ মিউ শুরু করে দিয়েছে। আমি বিরক্ত হয়ে আমার স্ত্রীকে বললাম এটি কোত্থেকে এলো? তাড়াতাড়ি এটিকে তাড়িয়ে দাও। সে বলল, পর্ণি এটিকে পোষছে। পর্ণি আমার ভাতিজির নাম। আমার মেজাজ যতটা গরম হয়েছিল পর্ণির নাম শুনে তার চেয়ে কয়েক গুণ নরম হয়ে গেল। সে আমাদের পরিবারের অত্যন্ত অদুরে মেয়ে। তার আবদার আমরা সযন্তে রক্ষা করি কারণ তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলে আমাদের রক্ষা নেই। অগত্যা কী আর করা বললাম, এটিকে একটা প্লেটে একটু দূরে খাবার দিয়ে এসো।

পর্ণি এর নাম রেখেছে মিনি। মিনির সাথে পর্ণির দিন কাটে খুব আনন্দে। একে গোসল করানো খাওয়ানো সব পর্ণি রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। পর্ণিকে না দেখলে মিনিও মিউ মিউ শুরু করে দেয়। আমার মা এর জন্য তাকে কত উপহাস করে কিন্তু সে এ সবে কান দেয় না। একদিন বিড়াল ছানাটি দিনের বেলায় পেশাব করে মার বালিশ ভিজিয়ে দিলো। বলা বাহুল্য পর্ণি বাড়ির মাঝে তার দাদুকেই একটু ভয় করে আর কাউকে নয়। এ নিয়ে দাদু তাকে বকুনি দিয়েছে। দাদুর বকুনি খেয়ে সে তার কাকীর কাছে এসে কাঁদতে লাগল। কাকী জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা মনি? সে তখন বিড়ালের বালিশ ভিজানোর ঘটনাটা তার কাকীর কাছে বলল। শুনে তার কাকী হাসতে হাসতে বলল, মা হয়েছে অথচ মেয়ের মূত ধুইতে পার না, এ কেমন মা? যাও বালিশ নিয়ে এসো। সে চুপি চুপি গিয়ে বালিশ নিয়ে এলো। তার কাকী বালিশের কভার ধুয়ে, বালিশ ও কভার রোদে শুকিয়ে নিয়ে যথা স্থানে রেখে দিলো। বিড়ালের এ হেন কুকর্মে বিড়ালের প্রতি তার বিরক্তির পরিবর্তে আসক্তি আরও বেড়ে গেল। একদিন আমাকে এসে ধরল তাকে একটি লাল ফিতা, একটি নূপুর ও একটি মেহেদি কিনে দিতে। দিলাম কিনে। পর দিন দেখি বিড়ালের সারা শরীরে মেহেদির কারুকাজ, গলায় লাল ফিতা ও নূপুর শোভা পাচ্ছে। দিনে দিনে বিড়াল ছানাটি বেশ বড় হয়ে উঠেছে। এখন আর আগের মত উৎপাত করে না। খাবার সময় পাতের কাছে এসে চুপচাপ বসে থাকে। প্লেটে কিছু দিলে মন চাইলে খায়, না চাইলে বসে থাকে।

এবার কুরবানির ঈদে আমার সব বোনেরা বেড়াতে এসেছে। আমার ছোট বোনের দুবছর বয়সের একটি মেয়ে আছে, তার নাম অর্ণি। সে খুব চঞ্চলা প্রকৃতির। হাতের কাছে যা পায় সব ভেঙ্গে ফেলে। ভাঙ্গতে না দিলে কান্না শুরু করে দেয়। কয়েক দিনে মিনির সাথে তার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। মিনিকে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে কোলে নিয়ে বেড়ায়। মিনিও এ আদর-সোহাগ বেশ আয়েশের সাথে উপভোগ করে। এ নিয়ে পর্ণির সাথে তার মাঝে মাঝে ঝগড়াও হয়। ঈদের দুদিন কী তিন দিন পরের ঘটনা। মা ফজরের নামাজ পড়ে বারান্দায় বেস তসবিহ জপছিল। উঠোনে পর্ণি, অর্ণি ও মিনি খেলা করছিল। আমাদের ঘরের সামনে বারান্দা ঘেঁষে একটা হাসনাহেনা ফুলের গাছ আছে। রাতে গাছটিতে অনেক ফুল ফোটে। ফুলের গন্ধে সারা রাত বাড়ি মৌ মৌ করে। সকাল বেলা অধিকাংশ ফুলই ঝরে পড়ে। এটি হাসনাহেনা ফুলের বৈশিষ্ট্য। অর্ণি ঝরা ফুল কুড়ানোর জন্য গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে যেই মাত্র ফুল গাছে কাছে এলো এমনি (সেখানে আগে থেকেই আসা সম্ভবত পোকা-মাকড় খেতে এসেছি) একটা গোখড়ো সাপ ফণা তুলে অর্ণিকে ছোবল মারতে উদ্ধত হলো। দৃশ্য দেখে মিনি বিদ্যুতবেগে সাপটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে তার ফণাসহ মাথা কামড় দিয়ে ধরে রাখল। সাপটি মিনির সারা শরীর পেঁচিয়ে নিলো। তবু মিনি ফণা ছাড়ছে না। ঘটনা দেখে মা চিৎকার দিয়ে আমাদের ডাকতে লাগলেন। আমরা সবাই যার যার ঘর হতে বেড়িয়ে এলাম।  দৃশ্য দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। মিনি আমাদের দেখে আশস্ত হয়ে সাপের ফণার কামড় ছেড়ে দিলো। ছাড়া পেয়েই সাপটি ফোঁস করে মিনিকে ছোবল মেরে বিদ্যুৎ বেগে চলে গেল। আমরা তাকে মারতে পারলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যে মিনি, পর্ণি ও অর্ণির সব আদর -সোহাগের মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। নিজের জীবন দিয়ে মিনি অর্ণির জীবন বাঁচিয়ে গেল।