জীবনব্যাপী বিয়োগ ট্র্যজেডির কাতরতায় রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠা

তাহাজ উদ্দিন/
যতবারই ডাঙার খুঁটিতে রশি বেঁধেছেন ততবারই ছিঁড়ে গেছে। জীবনের এ ট্র্যজেডি রবীন্দ্রনাথ কোনদিনই ঘোঁচাতে পারেননি। জন্ম মৃত্যুতে ঈশ্বর এবং প্রকৃতির সীমারেখা মেনে বারবার তিনি মৃত্যু শোক আলিঙ্গন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠার জন্য এটিই হয়তো তাঁর নিয়তি।
নানাভাবে সমৃদ্ধ এবং কোলাহলময় পারিবারিক পরিমন্ডলে কবির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সেই সাথে পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা অনুশাসন, অনুপ্রেরণায় পিতাই হয়ে উঠেন তাঁর জীবনের অনেকটাই আদর্শ। অস্থির মনের এক কিশোর রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যু এবং মৃত্যু শোক অনেকটা অস্পষ্ট তার কাছে। জীবনের ঠিক এই সময়ে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু হয়। মাতৃহারা কিশোর রবীন্দ্রনাথকে মাতৃশোক আর অভাব ভুলিয়ে রাখতে প্রিয় বৌদি কাদম্বরী দেবী হয়ে উঠেন সকল অভিমান, রাগ অনুরাগ, চাওয়া পাওয়া সহ সকল মানুষিক অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল। প্রিয় বৌদি ছিল তাঁর সকল ভুবন এবং অস্তিত্বে একাকার। এই সময়ই তিনি কবি হয়ে উঠতে শুরু করেন। কারণ মাতৃবিয়োগের পর রবীন্দ্রনাথের যৌবনে পদার্পণ অবধি কবির ভাবনা আর বিকাশে কাদম্বরী দেবীর পরতে পরতে বিচরনের বিস্তর কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। কাদম্বরী দেবীর প্রভাবেই মাতৃহারা বেদনা, বিমর্ষতা ভুলে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন সকল বিষয়ে কৌতুহলী এবং সৃজনশীল।
মাতৃবিয়োগের দশ বছর পর ২২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। স্ত্রী হিসেবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ ঘটে যশোরের এক রায় চৌধুরী পরিবারের বেনীমাধবের কন্যা ভবতারিণী দেবীর। ঠাকুরবাড়িতে যাঁর নতুন নামকরন হয় মৃণালিনী। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের রাতে বড় ভগ্নিপতি সারদা প্রসাদ মারা যান। বিয়ের মাত্র চার মাস পরেই সেই প্রিয় বৌদি কাদম্বরী দেবীরও মৃত্যু হয়। ১৮৮৪ র এপ্রিলে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু নিয়ে নানা কথা, নানা প্রশ্ন থাকলেও রবীন্দ্রনাথের কাছে তার মৃত্যুটাই সত্য এবং রবীন্দ্রনাথ মানষিক ভাবে ভেঙে পড়েন।
মাতৃবিয়োগের পর যে মানুষটিই কিশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত সকল ভাবনার জগতে ছিল একাকার! সেই প্রিয় বৌদির মৃত্যু শোক পাড়ি দেওয়া রবীন্দ্রনাথের জন্য অত্যান্ত কঠিন ছিল যা সারাজীবন তাঁকে তাড়িত করেছে। বিয়ের পর কর্তব্যবোধ এবং ভালবাসার কোন কমতি ছিল না মৃণালিনী দেবীর মধ্যে। তাই রবীন্দ্রনাথ একান্ত সিক্তও ছিল স্ত্রীর প্রতি। মাত্র ১৯ বছর সংসার এবং দাম্পত্য জীবন দু’জনের। এক অগ্রহায়ণে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এসে আর এক অগ্রহায়ণে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃণালিনী দেবী চলে গেলেন সকল কিছু ছেড়ে। সবচেয়ে বেশি ভাসিয়ে গেলেন পাঁচ সন্তানকে। মাতৃহারা সেই অবস্থায় রবীন্দ্রনাথই হয়ে উঠলেন সন্তানদের মা একই সাথে বাবাও। পরম মমতায় সন্তানদের আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন অবিরাম। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু দিয়েই শুরু হলো রবীন্দ্র জীবনে একের পর এক মৃত্যুর মিছিল। শোকের অশ্রু মালা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হয়েছে শুধু।
সন্তানের চেয়ে দুর্বল জায়গা মানুষের নাই। সমগ্র জীবজগতেরও একই চিত্র। বিশ্বপ্রতিপালক তার বিশ্বচরাচরের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতেই জীবজগতে সন্তানের প্রতি এক চরমতম দুর্বলতা স্থাপন করে দিয়েছেন। সন্তানের সামান্যতম কষ্টেও মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। নিজের জীবন বিপন্ন এবং অবলীলায় উৎসর্গ করে সন্তান রক্ষা করার কত নির্মমতর দৃষ্টান্ত পৃথিবী দেখে আসছে সৃষ্টির আদি থেকে। সেই সন্তানের অকাল মৃত্যু একের পর এক প্রত্যক্ষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান মাধুরীলতা বা বেলা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মাধুরীলতার বিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরচ্চন্দ্রের সাথে। মাতৃহারা মাধুরীলতা রবীন্দ্রনাথের অত্যান্ত আদরের মেয়ে। মেয়ের সুখের প্রশ্নে জামাইকে তিনি বিলেত পাঠিয়েছিলেন ব্যরিস্টারী পড়তে। এই জামাই কারনে অকারনে কত অবর্ননীয় কষ্ট দিয়েছে কবিকে। এত কষ্ট সহ্য করেও শেষ রক্ষা হয়নি। স্বামীর কাছে নানা অযত্নে অবহেলায় ১৯১৮ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে মাধুরীলতার মৃত্যু হয়।
মা মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর কবির দ্বিতীয় কন্যা রেনুকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। খানিকটা অসুস্থ অবস্থায় রেনুকাকে বিয়ে দেন কবি মাত্র ১১ বছর বয়সে। এই জামাই সত্যেন্দ্রনাথকেও ডাক্তারী পড়তে বিদেশ পাঠান রবীন্দ্রনাথ মেয়ের সুখের কথা ভেবেই। সত্যেন্দ্রনাথও কবিকে কম দুঃখ কষ্ট দেননি। মেয়ের মুখ চেয়ে সকলই সহ্য করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বিয়ের মাত্র দুই বছরের মাথায় যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে নিঃসন্তান রেনুর মৃত্যু হয়।
রবীন্দ্রনাথকে জানতে পেরেছি খুবই সামান্য। অতি সামান্য এই জানা থেকেই একটি খটকা আমার রয়েই গেল। অতি অল্প বয়সে ১১ থেকে ১৫ বছরে মেয়েদের তিনি বিয়ে দিয়েছেন। দুই মেয়ের অকাল মৃত্যুর কারন হয়তো হতেও পারে বিয়ের সময় অপরিনত বয়স। স্বামীর সাথে বয়সের তারতম্য বিস্তর এবং অস্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের মত মানুষ এতটা অপরিনত বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিলেন!! তাহলে কি মাতৃহারা বালিকাকে স্বামীর আশ্রয়ে
পাঠানো! নাকি নিজের দায় শোধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব! অথবা রবীন্দ্রনাথ সকল কিছু অতিক্রম করলেও এক্ষেত্রে সেই সময় এবং চলমান সমাজ ব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে পারেননি। মেয়েদের অকাল মৃত্যুর কারনে তাঁর ভেতরটা যখন ভেঙে চুরমার তখন নিশ্চয়ই সেটি তিনি উপলব্ধি করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে – রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেক জামাই তাঁর সাথে অতি নিষ্ঠুর আচরন করে গেছেন এবং এসব অবর্ণনীয় আচরনে তিনি সব সময়ই থেকেছেন নিশ্চুপ নির্বিকার।
রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ছিল কবির খুবই আদরের। মাতৃহারা ছোট ছেলেটাকে নিয়ে কতনা আকাংখা লালন করতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু নিয়তি বরাবরই কবির পেছন থেকে মুচকি হেসেছেন। নিয়তির কাছে সমর্পণ করে ছেড়ে দিতে হয় আদরের ছোট্ট শমীন্দ্রনাথকে চিরতরে। মাত্র ১১ বছর বয়সে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুর ঠিক ৫ বছর পর একই তারিখে শমীর অকাল মৃত্যুর পথে যাত্রা।রবীন্দ্রনাথের ভেতরটা ভেঙে খানখান। কিন্তু বাহিরে নির্বিকার। তাইতো তিনি ছেলেকে দাহ করেই তখনি বঙ্গভংগের মিটিংয়ে যোগ দিতে যান।
ভেতরটা কি পরিমান পুড়লে রবীন্দ্রনাথের মত মানুষ এমনটি করতে পারেন।
ছোট মেয়ে মিরার বিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ তের বছর বয়সে। মিরার স্বামী নগেন্দ্রনাথকেও কবি আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন কৃষি বিদ্যা শিখতে। মেয়ের সুখ এবং কৃষি বিদ্যা দেশের কাজে লাগবে এই ছিল তাঁর প্রত্যাশা। রবীন্দ্রনাথের নাতি নাতনির সংখ্যা কেবল তিন জন। নাতি নিতিন্দ্রনাথ মিরার একমাত্র সন্তান। রবীন্দ্রনাথ নিতিনকে ভাল বাসতেন খুবই। তিনিই নিতিনকে উচ্চ শিক্ষার জন্য জার্মানিতে পাঠান। এ বাঁধন খানিও কবির জীবনে সহে নাই। নিতিন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান। রবীন্দ্রনাথের কোনো উত্তরসূরী আছে কিনা সেটি জানা যায় না।
১৯০২ থেকে ১৯০৭ এই পাঁচ বছর রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে বিচ্ছেদের সবচেয়ে গভীর ক্ষতের অমোচনীয় দাগে দগ্ধ। ১৯০২ এ স্ত্রী বিয়োগ, ১৯০৩ সালে প্রিয় কন্যা রেনুর মৃত্যু, ১৯০৫ সালে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং ১৯০৭ সালে প্রানপ্রিয় কনিষ্ঠ সন্তান শমিন্দ্রনাথের মৃত্যু।
জীবনব্যাপী আরো কত আপনজনের মৃত্যু তার তালিকা দীর্ঘতর।রবীন্দ্রনাথের জীবনে একের পর এক মৃত্যুর এই অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে অনেকটা বিরল।
রবীন্দ্র মানষে হাহাকার জাগানো মৃত্যুর মিছিলই যে তাকে রবীন্দ্রনাথ করে তুলেছে তাতে বিতর্ক হয়তো নিতান্তই কম। কারণ উপর্যুপরি অকাল বিচ্ছেদের অসহনীয় শোক আর বেদনা ভুলে থাকতে নিজের প্রতি আরোপ করেছেন চরমতম নিষ্ঠুরতা। ২৪ ঘন্টায় ঘুমিয়েছেন মাত্র ৩ ঘন্টা। ২১ ঘন্টা ভাটা শ্রমিকের মত, খনি শ্রমিকের মত, নির্মাণ শ্রমিকের মত নিদারুণ খেটেছেন শারিরীক এবং মানষিক ভাবে। সৃষ্টি করেছেন যত তার তুলনা করে কার সাধ্য।
বিশ্বপ্রকৃতিই ছিল রবীন্দ্রনাথের পাঠশালা। রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে পারে সে মানুষের সংখ্যা কত তা আমার জানা নাই। কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতিতে বিরাজমান এমন কিছু নাই যা নিয়ে রবীন্দ্র ভাবনার প্রকাশ ঘটেনি। বহুমুখী জীবন দর্শনের পাঠ বাঙালি শিখেছে রবীন্দ্রনাথের কাছেই।
বাঙালির জন্য ধরিত্রী মাতার যে দান সর্বংসহা সেই ‘রবীন্দ্রনাথ’ এখন পর্যন্ত বাঙালি তার যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে কি? রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের অযোগ্যতার কৈফিয়ত প্রকাশের কোন ভাষাও নাই।
১৬২ তম জন্মদিন আজ রবীন্দ্রনাথের। যারা রবীন্দ্রনাথকে বুঝার চেষ্টা করেছেন – তাদের সামনেই তো রবীন্দ্রনাথের বেড়ে উঠা এবং রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠার ইতিহাস জ্বলজ্বল করে। জগতের কল্যানে নিজের প্রতি কি পরিমান নিষ্ঠুর হওয়া যায় সেটি রবীন্দ্রনাথ জীবনের পরতে পরতে আমাদের শিখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ত্যাগ আর ভাবনার দায় বাঙালির জন্ম জন্মান্তরের। শোককে শক্তিতে পরিনত করে খনি শ্রমিকের মত নিষ্ঠুর খাটুনি সহ্য করে যে পরিমান রত্ন ভান্ডারে বাঙালির ঝুলি ভরে দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, ঝুলি ফাঁক করে সে রত্ন ভান্ডার দেখার সুযোগ সময় কোনটিই আমাদের হয়ে উঠেনা। বাঙালি হয়ে উঠাও আমাদের জন্য দুরূহ তাই।
সমাজ, সভ্যতা, মুল্যবোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং জাগ্রত রাখতে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকতা একান্ত আবশ্যক বাঙালির জীবনে। কবি গুরুর ১৬২ তম জন্ম বার্ষিকীতে রবীন্দ্র প্রাসঙ্গিকতার নতুন মাত্রা সঞ্চারিত হোক আমাদের ভাবনায় এবং আদর্শে সেটিই একান্ত প্রত্যাশা।