শীতে গ্রামের বাড়ি

আবরার নুর ফাহিম/
শীতকালীন ছুটি কাটাতে এবার অনেক দিনপর গ্রামে এলাম। গ্রামের ছেলে হলেও শহরে থেকে অনেকটা শহুরে হয়ে গেছি। কিন্তু মাটির টানকে তো আর অস্বীকার কারা যায় না। তাই তো সময় সুযোগ পেলেই ছুটে আসি গ্রামের টানে। শীতে কেমন যেন অচেনা মনে হয় গ্রাম। সেদিন অভ্যসমত খুব ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। তারপর তীব্র শীত উপেক্ষা করে কুয়াশা ভেজা গ্রামের পথে নেমে পড়ি। সমগ্র প্রকৃতি জুড়ে কেমন যেন শীতল প্রশান্তির পরশ লেগে আছে। মেঠোপথ ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছি। সে এক অবর্ণনীয় ভালোলাগার শিহরন ছুয়ে যাচ্ছে আমাকে। পাতাঝরা শিশিরের টুপটাপ শব্দ এবং ভোরের কুজন ছাড়া সমগ্র প্রকৃতিতে আশ্চর্য নিরবতা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কুয়াশার ঘনত্ব। এক’শ হাত দুরের বস্তু দেখা যাচ্ছে না। গামছায় মুখ-মাথা ঢাকা কে একজন এগিয়ে এল হঠাৎ। আমায় দেখে থমকে দাঁড়ালেন। অমিও দাঁড়ালাম।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, কেমন আছো ফাহিম। অনেকদিন পর গ্রামের বাড়িতে আইলা।
চিনতে পারলাম আমার লোকমান চাচাকে। তার বাড়ি আমার বাড়ীর পাশে। তারপর তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে গেলাম সেই ফেলে আসা শৈশবে। সেখান থেকে এলাম সরিষা ক্ষেতে। হলুদের বন্যা তখন মাঠ জুড়ে। ক্রমেই সুর্য উঠছিলো আর কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সমগ্র প্রকৃতিতে নবজীবনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
পথে পথে গ্রামীন কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেছে। লাঙ্গল গরু নিয়ে পথে নেমে পড়েছে চাষী। কেউ যাচ্ছে আলু লাগাতে, কেউ যাচ্ছে পেঁয়াজ লাগাতে। কেউ যাচ্ছে জমি চাষ করতে। দৃশ্যটা খুবই সাধারণ অথচ নিগুড় বৈচিত্র নিয়ে তারা জীবন যাপন করছে। যা শহুরে জীবনে খুজে পাওয়া যায় না।
শিশিরশিক্ত মাঠ পেরিয়ে বাড়িতে এসে দেখি রসের পিঠার বিশাল আয়োজন। বাতাশে পিঠার মৌ মৌ গন্ধ আমাকে আকুল করে দিল। ঘরে ঘরে পিঠা খাওয়ার আনন্দ। হিমশীতল ঠান্ডায় ভাপা, দুধপুলি, দুধচিতই, পাটিশাপটা প্রভৃতি পিঠা। চাদরমুড়ি দিয়ে পিঠা রসনায় আনে তৃপ্তি। কনেকনে শীতে দলে দলে সবাই মিলে আগুন পোহানো কম আনন্দের নয়।
অন্যদিকে গৃহহীন বস্ত্রহীন মানুষ খুজে একটু আশ্রয় প্রশান্তির উষ্ণচাদরে। দরিদ্র ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রোদের আদরের ভরসায়। গাছিরা বাড়ী বাড়ী খেজুরের রস বিক্রি করতে আসে। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু গ্রামের সাধারণ দৃশ্য। আমার গ্রামের বাড়িতে মাঠ পেরলেই পদ্মা নদী। শীতের সকালে কুয়াশা থাকায় নদীতে নৌকা চলাচল কম থাকে। নদীকে দেখে মনে হয় যেন শীতের ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে এক শান্তসুবোধ বালিকা। ওদিকে ধানকাটা মাঠে কী সীমাহীন শুন্যতা, কী বিশাল কারুকার্য্য। ত্যাগের কী অপরুপ মহিমা। বাড়ীর অঙ্গীনায় গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, রক্তজবা ফুলের সমরাহ। শিশির ভেজা দুর্বা ঘাসে সুর্যালোক পড়লে মনে হয় মুক্তা ঝলমল করছে। মৌমাছিরা গুনগুন শব্দে ছুটে যায় সরষে ফুলের দিকে। সবমিলে গ্রামকে প্রকৃতির সুরম্য লীলা ক্ষেত্র বললে মোটেই অত্যুক্তি হয়না।
এক আনন্দমুখর শীত কাটালাম এবার শীতকালীন ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসে। আমার জীবনের এক অপার্থিব অনন্দময় অভিজ্ঞতা যা সারা জীবন অম্লান হয়ে থাকবে স্মৃতিপটে।

(লেখক- কোলদিয়াড় মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।)