পবিত্র আশুরার তাৎপর্য

পবিত্র আশুরার তাৎপর্য
শাহ সুফী সাইয়েদ আহমাদুল্লাহ্ যোবায়ের/

ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত তার একটি হচ্ছে মহরম। ১০ মহরম অর্থাৎ আশুরার দিনটিকে আল্লাহ বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল এই দিনকে বলা হয় পৃথিবীর আদি অন্তের দিন। অর্থাৎ এই দিনেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে, আবার এই দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। এই দিনটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলমানদের জন্য এই দিনে রোজা রাখা ফরজ ছিল। এরপর যখন হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন এই আশুরার ১০ তারিখের রোজাটি আমাদের জন্য নফল হয়ে যায়। এই ১০ মহরমের সঙ্গে মিলিয়ে নবি করিম (স) আমাদেরকে আরেকটি রোজা পালন করার নির্দেশ করেন। মহরমের ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ আমরা নফল রোজা পালন করে থাকি। মুসনাদে আহমাদের এক বর্ণনায় এসেছে, নবি করিম (স) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহ পাকের কাছে আমি আশাবাদী, আল্লাহ এ রোজা পালনের ফলে এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ যে ঘটনাগুলোর কারণে আশুরা তাৎপর্যময় এবং মুসলমানদের ঐতিহাসিক শোকের নিদর্শন হয়ে আছে সংক্ষেপে সেগুলো হচ্ছে—(১) আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আবার এই দিনেই তিনি কেয়ামত ঘটাবেন। (২) আশুরার দিনে হজরত আদম (আ) বেহেশত থেকে দুনিয়ার বুকে নেমে আসেন। আবার এই দিনেই আল্লাহ পাক আদম (আ)-এর দোয়া কবুল করেন, এই দিনে আরাফাতের ময়দানে হওয়া (আ)-এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। (৩) হজরত নূহ (আ)-এর জাতির লোকজন আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিমজ্জিত হওয়ার পর আশুরার এই দিনে নৌকা থেকে ইমানদারদের নিয়ে জমিনে অবতরণ করেন। (৪) হজরত ইবরাহিম (আ) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর আশুরার এই দিনে সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন। (৫) হজরত আইয়ুব (আ) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর আশুরার এই দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন। (৬) হজরত ইয়াকুব (আ)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ) তার সৎ-ভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কূপে নিক্ষিপ্ত হবার পর মিশরে গিয়ে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছিলেন, দীর্ঘ ৪০ বছর পর আশুরার এই দিনে তার পিতার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। (৭) হজরত ইউনুস আ. আশুরার এই দিনে ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন। (৮) আশুরার এই দিনে আল্লাহ হজরত মুসা (আ)-কে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, আর ফেরাউন ও তার দলবলকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। (৯) হজরত ঈসা (আ)-এর জাতির লোকেরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করলে আশুরার এই দিনে আল্লাহ তাআলা তাকে আসমানে উঠিয়ে নেন। (১০) আশুরার এই দিনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে নবি করিম (স)-এর কলিজার টুকরা আদরের নাতি ইমাম হুসাইন (রা) অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শাহাদতবরণ করেন। আর কারবালার এই মর্মান্তিক ঘটনা ১০ মহরম সংঘটিত হওয়ার কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ দিনটিকে স্মরণ করে নবি পরিবারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা জাগ্রত হয়ে থাকে। ইমাম হুসাইন (রা) আমাদের জন্য যে সত্যের শিক্ষা রেখে গেছেন তা দিয়ে পথচলার প্রেরণা পেয়ে থাকি। কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তা হচ্ছে—মুসলমানদের বড় শক্তি হচ্ছে তাদের মজবুত ইমান। তাই আমাদের ইমানি চেতনায় বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে জীবন পরিচালনা করতে হবে। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা) সপরিবারে আত্মত্যাগ করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন, যে মস্তক আল্লাহর কাছে নত হয়েছে সে মস্তক কখনো বাতিলের কাছে নত হতে পারে না। আল্লাহর পথে অটল থাকতে মুমিনরা কখনো তাদের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। তাই আজকের মুসলমানরা সব অন্যায়ের ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারলেই ইমাম হুসাইন (রা)-এর ত্যাগ সার্থক হবে; এটাই কারবালার শিক্ষা। সর্বোপরি আমাদেরকে নবি করিম (স)-এর আখলাক, তার আদর্শ ধারণ করতে হবে। আহলে বাইত তথা নবি পরিবারের প্রতি হূদয়ের ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। ইমাম হুসাইন রাযি. কারবালার প্রান্তরে উম্মাহর জন্য যে ত্যাগের শিক্ষা রেখে গেছেন, তা অনুসরণ করে মুসলিম উম্মাহ চিরদিন সত্যের পথে অবিচল থাকবে—এটাই হোক আশুরার শিক্ষা। (ইত্তেফাকের সৌজন্যে)

লেখক :বর্তমান সাজ্জাদানশিন পির সাহেব ও মোতাওয়াল্লি, আজিমপুর দায়রা শরীফ, ঢাকা