করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের পাশে দাঁড়ান

নিতাই চন্দ্র রায়/
স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলাদেশের প্রকৃতি, জলবায়ু, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস মাছের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালির জীবন-জীবিকার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে মৎস্য আহরণ ও মৎস্যকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড। এ জন্যই প্রবহমান নদী ও খাল-বিলের পাশে গড়ে ওঠে অসংখ্য জেলেপল্লী। বর্ষাকালে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। নদীনালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা পানিতে থইথই করে। মাছ ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে পোনা হয়। মুক্ত জলাশয়ে বিচরণ করে পোনাগুলো পরিণত হয় বড় মাছে। মাছ উৎপাদনের জন্য এ রকম উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ পৃথিবীতে সত্যিই বিরল।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়, মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ এবং বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম। ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ। এ কথা স্বীকার করা বাঞ্ছনীয় যে, সরকারের মৎস্যবান্ধব নীতিমালা, মৎস্যচাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের অধিক উৎপাদনশীল মাছের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কারণে এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে। উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনামাছ অবমুক্তকরণ, মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন, মাছের আবাসস্থল উন্নয়ন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং চাষি পর্যায়ে লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তরমূলক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

বর্তমানে দেশে মাথাপিছু দৈনিক মাছের চাহিদা ৬০ গ্রাম। প্রতিদিন আমরা মাছ গ্রহণ করছি ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ অবদান মৎস্য খাতের। বিগত ৫ বছরে মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক মানুষ মৎস্য খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। ২০১৮-১৯ সালে দেশে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪২ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন, যা চাহিদার চেয়ে ৪৩ হাজার মেট্রিক টন বেশি। বিগত ১২ বছরে মৎস্য খাতে গড় উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ৪৫ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন।

দানা শস্য, শাকসবজি ও ফলমূল আবাদের চেয়ে মৎস্য চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় দেশের উদ্যমী শিক্ষিত যুবকদের একটি বড় অংশ গতানুগতিক কৃষির পরিবর্তে মৎস্য চাষকেই বেছে নিয়েছে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও স্বাবলম্বী হওয়ার উপযুক্ত উপায় হিসেবে। দেশের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে ময়মনসিংহ, নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, যশোর, রংপুর ও দিনাজপুরে অসংখ্য যুবক মৎস্য চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। কেউ করছে রেণু পোনা উৎপাদন। কেউ করছে পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, থাই কই, সিলভার, রুই, কাতলা ও মৃগেল মাছের চাষ। কেউ করছে পাবদা, গুলসা, শিং, মাগুর, বাটা মাছের চাষ। আবার কেউ কেউ করছে মাছের খাবার বিক্রির ব্যবসা। চালের কুঁড়া, সরিষার খৈল ও শুঁটকি কত কি। দেশে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মৎস্য চাষিদের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে দেশের প্রায় পৌনে দুই কোটি লোক তাদের জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য উপ-খাতের ওপর নির্ভরশীল। মৎস্য খাত সংশ্লিষ্ট এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ নারী, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ। এ ছাড়া বিগত ৫ বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অতিরিক্ত বার্ষিক ৬ লক্ষাধিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে মৎস্য খাত। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিকের ৮০ শতাংশের অধিক নারী।

বিগত ৬ বছরে উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনামাছ অবমুক্তকরণ এবং বিল নার্সারি স্থাপন করার ফলে দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে বার্ষিক প্রায় ২ হাজার ৫৭৫ মেট্রিক টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু মৎস্য অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা, মেরামত এবং উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কয়েকটি অভয়াশ্রম স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের ফলে বিলুপ্তপ্রায় এবং বিপন্ন ও দুর্লভ প্রজাতির মাছের পুনরাবির্ভাব ও প্রাপ্যতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। হালদা নদীর অভয়াশ্রম রক্ষায় নিয়মিত অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে হালদায় এ বছর ২৫ হাজার ৭৭১ কেজি ডিম পাওয়া গেছে, যা বিগত ১২ বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

পৃথিবীতে ইলিশ উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত মাছের শতকরা ১২ ভাগ আসে ইলিশ থেকে। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের বেশি। জাটকা সংরক্ষণ ও প্রজনন সময়ে মা ইলিশ আহরণ বন্ধ এবং জেলেদের খাদ্য সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে গত ১০ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় শতকরা ৭৮ ভাগ। বর্তমানে দেশে বার্ষিক ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন।

আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ প্রাণিজ আমিষের জোগান দেয় মাছ। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরও বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭০ হাজার ৯৪৫ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৩ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, যা রপ্তানি বহুমুখীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রাথমিক পর্যায়ে লকডাউন ও যানবাহন বন্ধ থাকার কারণে পানির দামে মাছ বিক্রি করে অনেক মৎস্যচাষি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন। ওই সময় বাজার ব্যবস্থা সচল রাখতে মৎস্য অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রয় কেন্দ্র ও গ্রোথ সেন্টারের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন মাছ বিক্রি করে, যার বাজার মূল্য ৫৬৫ কোটি টাকা। এতে কিছুটা হলেও মৎস্যচাষিরা লাভবান হন।

মৎস্য গবেষকদের মতে, সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিলুপ্ত হওয়ার পথযাত্রী প্রায় ২৩ প্রজাতির মাছকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এগুলো হলো পাবদা, গুলশা, ট্যাংরা, শিং, মাগুর, আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালি, রাজপুঁটি, মেনি, গুতুম, গজার, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালবাউশ, কই, গজার ও গনিয়া। প্রায় বিলুপ্ত অবস্থা থেকে প্রাকৃতিক পর্যায়ে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে হাওর এলাকা এবং মেঘনা নদীর অববাহিকায়। ওইসব এলাকায় রিটা, আইড়, বাগাইড়, নদীর পাঙ্গাস, শিলন, চিতল এবং সরপুঁটি মাছের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আজ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার ধান ক্ষেতে দেশীয় প্রজাতির কত সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেত। পুঁটি, টেংরা, শিং, মাগুর, টাকি, তারা বাইন, গুতুম, মলা, চান্দা, চেলা, বেলে ইত্যাদি। সে সময় ভাদ্র মাসে মেঘ ডাকলে খেলার মাঠ ও গ্রামের কাঁচা রাস্তায় কই মাছ উজিয়ে আসত। এখন এসব কথা জাদুর মতো মনে হয়। ধান ক্ষেতে নির্বিচারে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে আমরা দেশীয় মাছের উর্বর প্রজনন ক্ষেত্রকে ধ্বংস করেছি। ধ্বংস করেছি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে ফসলের মাঠে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে। দেশের নদীনালা, খালবিল দখল, দূষণ ও ভরাট বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে প্রাকৃতিক জলাশয়ে শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য ফেলার মতো পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ।

মৎস্যচাষিদের এই বিপদের সময়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাহস জোগাতে হবে। করোনা, আম্পান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের প্রকৃত তালিকা তৈরি করে তাদের বিনামূল্যে মাছের পোনা প্রদান ও নগদ সহায়তা দিতে হবে এবং নতুন করে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রদান করতে হবে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষের লাগসই প্রযুক্তি, যাতে মৎস্যচাষিরা আবার নতুন উৎসাহে মাছ উৎপাদন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেন।

লেখক

সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর